শনিবার, ১৬ জুন, ২০১৮

ইমরান ও তার ঈদ আনন্দ

রাজু! এই রাজু! ঘুম থেকে উঠ। আর কত ঘুমাবি?

সকাল ৯টা বাজে উঠলা ঘুম থেকে।

মায়ের পিড়াপীড়িতে ঘুম ভাঙল রাজুর। তবে আজ তার কোন কাজ নেই। নেই অফিস যাওয়ার তাড়া।
কারন ঈদেরছুটি চলছে। কাল ঈদ। 

রাজু একটি বেসকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে। চাকুরীর কারনে তাকে প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয়। ঘুম থেকে উঠতেই তার তাড়াহুড়ো শুরু হয় অফিসের গাড়ী ধরার জন্য। 
গত ৫ বছর ধরে একই কাজ করে যাচ্ছে সে। মাঝেমাঝে একটু তারাতাড়ি তার পিক-আপ পয়েন্টে পৌঁছে গেলে রাস্তার পাশের টং থেকে চা খেত।
সে সুবাদে একদিন রাজুর সাথে পরিচয় হয় চা বিক্রেতা ছেলেটার। ছোট ছেলে। বয়স আনুমানিক ৭-৮ বছর হবে। 
একদিন রাজু চা খাচ্ছিল। ঠিক তখন তার অফিসের গাড়ি চলে আসল। রাজু তাড়াতাড়ি মানিব্যাগ থেকে ২০টাকার নোট বের করে দিল। 

ছেলেটি বলল- "স্যার, ভাংতি টাকা নাই। আফনে কাল ট্যাহা দিয়েন। আফনের গাড়ি চ্যইল্লা আইছে।"
তাড়াহুড়া করে গাড়িতে উঠল রাজু। সাড়াদিন শুধু ছেলেটির কথা ভাবল।

পরদিন রাজু একটু আগে করে বাসা থেকে বের হল। কারন আজ সে ছেলেটির সাথে কথা বলবে। 

রাজু- "ছোট ভাই, একটা চা দাওতো। চিনি কম দিবা।"

ছেলেটি- "জানি স্যার, আফনে চিনি কম খান।"

রাজু- তোমার নাম কি?

ছেলেটি- জি,  ইমরান। স্যার, আপনার চা নেন।

রাজু- "ইমরান তোমার বাড়ি কয়?"

ইমরান- " স্যার, ভোলা।"

রাজু- " এইখানে কবে আসছ?"

ইমরান- ২মাস অইবো।

রাজু- এখানে কার সাথে থাক?

ইমরান- আমাগো এলাকার লোক আছে না, ওদের লগে থাহি। আমার টাহা বেশি দিতে হয়না।

রাজু - কেন?

ইমরান- আমি ছোটতো। আর আমি খাডে হুতি না। নিছে হুতি। তাই আমি ৪০০ টাকা দিই।

রাজু- বাড়িতে কে কে থাকে?

ইমরান- আমার আম্মা আর আমার ছোড বইন।

রাজু- তোমার আব্বা কই?

ইমরান- আব্বা আর একডা বিয়া কইচ্ছে। আমাগো লগে থাহে না। আমরা আমার নানার বাড়ি থাহি। স্যার আমার বইন ক্লাস ওয়ানে পড়ে। বড় হইলে চাকুরী করব। আপনাদের গাড়িতে একডা আফা আছেনা উনার মত চাকুরী করব।

এইভাবে মাঝেমাঝে কথা হত রাজু আর ইমরানের। তার বাড়ির কথা, তার মায়ের কথা, তার বোনের কথা। তার বোনকে সে খুব ভালবাসত। এতটুকু ছেলে কিভাবে টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করে। তার সাথে কথা বলতে বলতে ইমরানের প্রতি রাজু এক অজানা ভালবাসা জন্মাল।

মাঝেমাঝে ইমরানের সাথে হাসিঠাট্টা করত রাজু। ইমরান দেশের সব জেলায় যাবে শুধু নারায়ণগঞ্জ যাবেনা। রাজু সেটা জানল তার ইমরানের এক বন্ধুর কাছ থেকে।

রাজু একদিন ইমরানকে জিজ্ঞাস করল- ইমরান! নারায়ণগঞ্জ যাবি? 

ইমরানের উত্তর - না, 

ওখানে ওর বাবা থাকে। যদি সে নারায়ণগঞ্জ যাই।  তাহলে তার বাবা তাকে সেখানে রেখে দেবে। সে তার বাবার কাছে যাবে না। সে তার মাকে দেখবে। তার বোনকে লেখাপড়া শিখাবে।

রাজুর মাঝেমাঝে ইমরানের কথা মনে পড়ত।

ঈদের আগের দিন, রাজু তার এক বন্ধু রাজীবকে ফোন করল। 
- দাদা, কয় আছেন?
- বাসায়
- বের হবেন?
- চেরাগি যাব? 
- ওকে! আসলে ফোন করবো।

রাজু বাসা থেকে খেয়ে দেয়ে দুপুরে বের হল। আজকে হঠাৎ চা খেতে ইচ্ছে হল।
রিক্সা নেওয়ার আগে রাজু গেল ইমারানের কাছে। 

রাজু- "ইমরান কেমন আছ? একটা চা দাও? চিনি কম।"

ইমারান কিছু বলল না, শুধু চা বানিয়ে বলল, চা লন।

রাজুর কেন যেন মনে হল, আজ ইমরানের মন খারাপ।

- কিরে ইমরান?  কি হয়েছে?

- স্যার কিছু না?

- ঈদে বাড়ি যাবি না?

- না। যামু না।

- ঈদে কি কি কিনলি?

- আম্মার জন্য শাড়ি কিনছি আর বইনের জন্য জামা কিনছি।

- তোর জন্য কিছু কিনস নাই?

- না, মায়ের শাড়ী আর বইনের জামা একরাম চাচারে দিয়া পাঠায় দিছি।

- তুই কিছু কিনস নাই ক্যান?

- স্যার, ট্যাহা নাই।

- এখন রমজান মাস। মাইনশে  রোজা রাখছে। চা বেশী বেঁচা যাইনা। তার উপ্রে পুলিশ প্রতিদিন জায়গার ভাড়ার নিয়া যাই আর কলেজের নেতারা ও ট্যাহা নিয়া যায়।  আপনেই কন, এত কিছু কিনার ট্যাহা থাহে ক্যামনে?

ইমরানের কথা শুনে রাজুর মন খারাপ হয়ে গেল। নিজেকে নিয়ে ভাবতে লাগল। কতটায় না সে কত দিকে খরচ করে।

মানিব্যাগ থেকে একহাজার টাকার একটা নোট ইমরানকে দিলা রাজু। 
- ইমরান এইটা তোমার ঈদের সেলামী। আজকে নিজের জন্য একটা শার্ট কিনে নিও। 
টাকাটা হাতে পেয়ে ইমরানের মুখে আনন্দের হাসি।
সে হাসি দেখে রাজুর মন ভরে গেল। 
ইমরান সাথে সাথে তার টং য়ের জিনিস পত্র গুছাইতে লাগল আর বলল-

-স্যার,  আমার কাছে ৫০০ ট্যাহা আছে। এগুলা দিয়া আমার জন্য কাপড় কিনমু আর আপনের টাহা দিয়া বইনের জন্য চুড়ি আর কসমেটিক কিন্না আইজ আইজ বাড়ি জামুগা।

রাজু তার মানিব্যাগ থেকে তার অফিসের ভিজিটিং কার্ড তার হাতে দিয়ে বলল,

- ইমরান, এখানে আমার মোবাইল নাম্বার আছে। বাড়ি গিয়ে তোমার টাকার দরকার হলে কোন দোকান থেকে ফোন করে একটা বিকাশ নং দিও। আমি টাকা পাঠিয়ে দিব।

এই বলে রাজু চেরাগি পাহাড় মোড়ের দিকে যাত্রা শুরু করল। বন্ধু রাজীবের সাথে দেখা, বাতিঘর থেকে বই ককিনা আর সন্ধ্যায় মিটিং শেষ করে বাসায় ফিরে লম্বা ঘুম।

সকালে তার বোন সীমার ফোনে রাজুর ঘুম ভাঙল। ফ্রেস হয়ে নাস্তা করে বোনকে কল ব্যাক করল। 
রাজুর আজ কক্সবাজার যাওয়ার কথা ছিল। তাই তার বোন তাকে বার বার ফোন করে খবরাখবর নিচ্ছিল। বোনের সাথে কথা শেষ করে ফোন রাখতেই অচেনা এক নাম্বার থেকে কল,
-হ্যালো,  কে?

- স্যার,  আমি ইমরাম। ঈদ মোবারক। আম্মাই কইছে প্রত্তম আফনারে ঈদ মোবারক কইতে।

- তোমার মা কেমন আছে? তোমার বোন কেমন আছে?

- স্যার, ভাল আছে।  আপনের তো অফিস নাই। আআমাগো বাড়ি চইল্লা আহেন?

- না, ইমরাম। আমি। একটু বিজি থাকব। পড়ে একদিন তুমি সহ তোমার বাড়িতে যাব।

- আইচ্ছা স্যার। রাহি।

- ওকে, ইমরান ভাল থেকো।

আজ রাজু খুব খুশি। আজানা এক আনন্দ তার মনে। ইমরানের ভালবাসা তাকে নতুন করে ভাবাতে লাগল।

ভাল থাকুক,  ইমরান ও তার পরিবার।

এই রকম অনেক ইমরান রয়েছে আমাদের আশে পাশে। আমাদের সামান্য সহযোগীতা ও ভালবাসা পারে তাদের মুখে হাসি এনে দিতে।







1 টি মন্তব্য:

  1. আজ রাজু খুব খুশি। আজানা এক আনন্দ তার মনে। ইমরানের ভালবাসা তাকে নতুন করে ভাবাতে লাগল।

    ভাল থাকুক, ইমরান ও তার পরিবার
    খুব ভাল লাগল পড়ে ধন্যবাদ রিপন দা

    উত্তরমুছুন