খেলাটি আমারা সকলে খেলেছি। জীবনে এমন কোন ব্যাক্তিকে পাওয়া যাবে না যে একবার ও এই খেলাটি খেলেনি। খেলাটিকে আমরা বলে থাকি সাপ লুডু। ইংরেজিতে বলে থাকি Snakes and Ladders.
শুনে অবাক হবেন যে এই খেলাটা যদিও ইংরেজদের খেলা বললেও সেটি কিন্তু আমাদের একটা প্রাচীন খেলা। এই উপমহাদেশের আবিস্কার।
অনেক আগে ১৩শ শতাব্দীতে ঋষি জ্ঞানদেব মজার এই খেলাটি আবিষ্কার করেন, যা আজ আমরা সাপ ও মই খেলা বলে খেলি। প্রাচীনকালে এটি মোক্ষপথ নামে পরিচিত, এই খেলার একটি উল্লেখযোগ্য এবং গভীর অর্থ ছিল। সাপেরা ভাস্কর্য দেখিয়েছিল, যখন মই ভাল গুণাবলী প্রকাশ করেছিল। খেলার সারাংশ ছিল যে মই ভাল গুণাবলী লোকেদেরকে স্বর্গে নিয়ে যায় যখন সাপ অপকার মানুষকে পুনরায় জন্মের একটি চক্রের দিকে নিয়ে যায়। এমনকি দাবা প্রাচীন ভারতের একটি জনপ্রিয় খেলা ছিল।
ব্রিটিশরা যখন আমাদেরকে শাসন করে তখন তারা এই খেলাটি সম্পর্কে জানে এবং ১৮৯২ সালে এই খেলাটির রুপ একটু পরিবর্তন করে John Jacques। ১৯৪৩ সালে ইংল্যান্ড থেকে খেলাটি আর একটু পরিবর্তন হয়ে আমেরিকা পৌঁছায় Milton Bradley এর হাত ধরে। তখনি এই খেলার নতুন নাম হয় "সাপ ও মই" Snakes and Ladders.
১৯৭৭ সালে দীপক সিংখাদা নামের এক যুবক শিকাগো শহরের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে বসে নেপাল এবং তিব্বতের বিভিন্ন ছবির সংগ্রহ তালিকা প্রস্তুত করছিলেন। এ সময় মিউজিয়ামের এক কোনে পড়ে থাকা এক অদ্ভুত ছবির ওপর তার দৃষ্টি চলে যায়। জাদুঘরের রেজিস্টারে ছবিটি নিয়ে শুধু বলা হয়েছে, ‘রিলিজিয়াস ওয়ার্ক’।
ছবিটি এক ভারতীয় আর্ট ডিলারের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল বলে জানা যায়। ছবিটি দেখে দীপক বেশ অবাকই হয়। কারণ ছবির মধ্যে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহাদেবের উপস্থিতি। আর জাদুঘরে এ ধরনের বিষয় নিয়ে আর কোন ছবিই চোখে পড়েনি। নানা পুথিপত্র পড়ে দীপকের কাছে বিষয়টি কেবল ধর্মীয় বিষয় বলে মনে হলো না, কেবলই তার মনে হতে লাগলো এর সাথে অন্য কোনো বিষয় জড়িয়ে আছে। তিনি বুঝতে পারলেন, ছবিটি উত্তর ভারত থেকে সংগ্রহ করা হলেও এর মূল লুকিয়ে আছে নেপালে। তার এক পরিচিত অধ্যাপক দীপককে জানালেন, এ ধরণের একটি ছবি তিনি নেপালের জাদুঘরে দেখেছেন।
এই ছবির রহস্য উন্মোচনের জন্য দীপক রওনা হলেন নেপালে। নেপালে পৌঁছেই উপস্থিত হলেন নেপালের ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। মিউজিয়ামের রেজিস্টার ঘাঁটতে শুরু করলেন যদি এই বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়। রেজিস্টারে শিকাগো মিউজিয়ামে দেখা এমনই এক ছবির কথা বলা আছে। জাদুঘর থেকে সে চিত্রকর্মটি বের করা হলো। নেপালের ন্যাশনাল মিউজিয়ামে পাওয়া এই চিত্রপটের নাম 'নাগপাশ'।
এই চিত্রকর্ম সম্পর্কে পড়াশোনা করতে গিয়ে দীপক দেখেন এটি কোনো ধর্মীয় বিষয় নয়। এটি একটি খেলার ছক। নেপালিরা শুদ্ধ করে এ খেলাকে 'নাগপাশ' বললেও মুখে তারা বলেন ‘বৈকুন্ঠ খেল’। আসলে এটি আমাদের অতি পরিচিত এক খেলা ‘সাপ লুডু’।
নেপালে পাওয়া নাগপাশের ছকেও রয়েছে এই সাপ। তবে নাগপাশে দুই ধরনের সাপ দেখতে পাওয়া যায়। লাল সাপ আর কালো সাপ। লাল শুভ-লাভ এবং সৌভাগ্যের প্রতীক। কালো সাপ অশুভ এবং দুর্ভাগ্যের প্রতীক। নেপালি নাগপাশে লাল-সাপের লেজে গুটি পৌঁছতে পারলে খেলোয়াড়কে তা অনেক উঁচু জায়গায় পৌঁছে দেয়। আর কালো সাপের মাথায় গুটি পড়লে একেবারে লেজের শেষে নেমে যেতে হয়।
আমরা যে সাপ-লুডু খেলি, তাতেও সাপের ব্যবহার আছে। এখানেও গুটি সাপের মাথায় পড়লে সাপের লেজের শেষে নেমে যেতে হয়। তবে এখানে উপরে উঠার জন্য লাল সাপের পরিবর্তে মই ব্যবহার করা হয়। আর তাই লাল সাপগুলো এখানে অনুপস্থিত। তবে এখনকার সাপ-লুডুতে কোথাও মই, কোথাও তীর আবার কোথাও রকেটও ব্যবহার করা হচ্ছে।
শুধু মজা পাওয়ার জন্য আমরা যেমন সাপ-লুডু খেলি, নাগপাশ খেলার উদ্দেশ্য ছিল তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। নাগপাশ খেলার উদ্দেশ্য ছিল অনেক গভীর এবং তার সাথে কিছুটা ধর্মেরও যোগাযোগ আছে। প্রাচীনকালে এই খেলার মাধ্যমে একজন খেলোয়াড় তার কর্মফল পরিমাপ করতেন। ভালো কাজের ফল পুণ্য, মন্দ কাজের ফল পাপ। সেকালের মানুষরা বিশ্বাস করতো, মানুষের এই পাপ-পুণ্য বা শুভাশুভ ফল ভবিষ্যৎ জীবন এবং পরজন্মের জন্য সঞ্চিত হয়ে থাকে। তারা বিশ্বাস করতো, ভালো কাজ করলে স্বর্গ আর খারাপ কাজ করলে নরক ভোগ করতে হয়।
জীবিত অবস্থায় একজন মানুষ ভাল কাজ করছে না মন্দ কাজ করছে, তা নিয়ে একটা সন্দেহ তখনকার দিনের মানুষদের মধ্যে প্রবলভাবে ছিল। এই কর্মফলে বিশ্বাসী মানুষের ভাবনা থেকেই নাগপাশ খেলার জন্ম নেয়। আর সে সময়ের মানুষদের কাছে নাগপাশ হলো কর্মফল পরিমাপ করার এক মজার উপায়।
১৯৭৫ সালে হরিশ জোহারি নামের এক পণ্ডিতের লেখা বইতে দেখা যায়, নেপালের নাগপাশ খেলার প্রচলন দশম শতকে হলেও তার বহু আগে থেকেই ভারতেবর্ষে এই খেলার চল ছিল। ভারতের দিকে এর খেলার নাম ছিল ‘জ্ঞান-চৌপার’ বা ‘মোক্ষ-পতমু’, অনেকে সংক্ষেপে বলেন মোক্ষপথ। আর তখন ভারত বা নেপাল বলে আলাদা কোনো দেশ ছিল না। তবে কীভাবে এই খেলা ভারত থেকে নেপালে গেল, সে সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। জ্ঞান-চৌপারের খেলার উদ্দেশ্যও নাগপাশের মতোই। এখানেও ৭২টি খোপ। তবে এখানে লাল সাপের পরিবর্তে তীর বা বাণ ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীকালে যা মই বা সিঁড়ির চেহারা নিয়েছে। সাপ-লুডুর মধ্যে যে কর্মফল, আত্মজ্ঞানের কথা রয়েছে, সেসব প্রতীকি বিষয়গুলো হারিয়ে গিয়ে আজ তা নিছক খেলায় পরিণত হয়েছে।
বিংশ শতাব্দীতে এসে সাপ-লুডু খেলাটি কোন নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারিদের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে তা সার্বজনীনতার রূপ পায়। ফলে খেলাটি বিভিন্ন বয়সী মানুষদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠে। বর্তমান সময়ে এসে ভিডিও গেমসের কল্যাণে এই ঐতিহাসিক ও জনপ্রিয় খেলাটি অনেকের মোবাইল ও কম্পিউটারে স্থান করে নিয়েছে। তাই কালের বিবর্তনে খেলাটিতে নানা পরিবর্তন আসলেও এর জনপ্রিয়তা আজও অমলিন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন