সোমবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২০

আইনে ‘মৃত্যুদণ্ড’ লিখলেই কি ধর্ষণ বন্ধ হবে ?

বিগত ১২ই অক্টোবর বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান যোগ করার সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পরদিন এ সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশে সই করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি সংশোধিত আইনটি কার্যকর করে। তবে আগে বাংলাদেশে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধর্ষণ, ধর্ষণ জনিত কারণে মৃত্যুর শাস্তি প্রসঙ্গে ৯(১) ধারায় ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। অবশ্য ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে বা দল বেধে ধর্ষণের ঘটনায় নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে বা আহত হলে, সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। সেই সঙ্গে উভয় ক্ষেত্রেই ন্যূনতম এক লক্ষ টাকা করে অর্থ দণ্ডের বিধানও রয়েছে।

সেই আইনে পরিবর্তন এনে ধর্ষণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলেই মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবনের বিধান রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে অর্থদণ্ডের বিধানও থাকছে। ধরনা করা হছে এতে করে ধর্ষণ কমে যাবে।

আসলে কি তাই ? শুধু আইনে ‘মৃত্যুদণ্ড’ লিখলেই কি ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে ? অনেকেই আশা করবেন এতে অপরাধীরা বেশি ভয় পাবে।

একজন ধর্ষক যখন এই জঘন্য কাজ করে, তখন কি তার মাথায় এটা থাকে যে এই কাজের জন্য তার মৃত্যুদণ্ড হবে না, হবে বড়জোর যাবজ্জীবন, তাই নো চিন্তা। তাই তারা ধর্ষণ করে। বর্তমান বাস্তবতায় ১৮০ দিনে জাতি ধর্ষকদের যাবজ্জীবন শাস্তি দেখে না,  ফাঁসি হলে কি তা দেখবে?

যদিও আইনে ছয় মাস বা ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার কথা বলা আছে। কিন্তু সেটা কাগজে কলমেই রয়ে গেছে। মামলার অভিযোগ গঠনে বিলম্ব এবং ধার্য তারিখে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী উপস্থিত না হওয়া, দ্রুত মামলার শুনানি শেষ না করা, ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দুই থেকে পাঁচ মাস পরপর তারিখ নির্ধারণ। এতে করে ধর্ষণের শিকার একজন নারী এবং তার পরিবারকে দীর্ঘসূত্রিতার ভোগান্তির স্বীকার হতে হয়।

যারা ধর্ষণ করে তারা সাধারণত ধর্ষিতার জানাশোনা বা পূর্বপরিচিত হয়ে থাকে। এখন যদি ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ড করা হয়, তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বরং এটা নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বাড়াবে। ধরুন যদি অপরাধী এটা বিবেচনায় নেয় যে মেয়েটি সাক্ষী হয়ে গেল এবং সে মুখ খুলতে পারে, তখন তাকে মেরে ফেলবে।

এদেশের আইনে অনেক অপরাধের শাস্তি  মৃত্যুদণ্ড আছে। তাই বলে কি সেই অপরাধগুলো কমেছে?

তবে আমি এই আইনের বিরোধীতা করছি না।  শধু আইন করলে এই সমস্যার সমাধান হবে না।  এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান আসতে হবে আমাদের সমাজ থেকে। যৌনতা আমাদের অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। এই স্বাভাবিক আচরণটাই যখন বিকৃত বা নোংরা রূপ নেয়, তখন-ই ধর্ষণের মত অপরাধগুলো জন্ম নেয়। কিন্তু, এই মানসিক বিকৃতির কারণগুলো প্রেক্ষিত অনুযায়ী তৈরি হয়।

সবচেয়ে কঠিন সত্যটা হচ্ছে ধর্ষণ প্রতিরোধের কার্যকরী ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত আমাদের দেশ নেয়া হয় নাই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই বিষয়টা বরাবরই উপেক্ষিত হইয়ে আসছে। তবে কিছু কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আমরা ধর্ষণ প্রতিরোধে সক্ষম হতে পারি।

১। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের পরিবর্তন আনা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কারণে অনেক পুরুষেরাই মনে করে থাকেন তাদের অবস্থান নারীদের উপরে। সে কারণে নারীদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার গুরুত্ব দেন না।

২। ছোটোবেলা থেকেই মেয়েদের শেখানো হয় তার সৌন্দর্যই আসল। ছেলেদের শেখানো হয় নারীদের সৌন্দর্যই তাকে পরিমাপের মাপকাটি। যার কারনে বাহ্যিক সৌন্দর্য সচেতন নারীরা নিজেদের বস্তু বানিয়ে ফেলছে। অথচ বাহ্যিক সৌন্দর্যের তুলনায় ব্যক্তিত্ব অধিক গুরুত্ব বহন করে। যখন নারীদেহকে একটি বস্তু মনে করা হয় তখন সেখানে ধর্ষণ বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে।

৩। মিডিয়া এবং যোগাযোগ মাধ্যম কর্তৃক ব্যবস্থা গ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টেলিভিশন, রেডিও এবং সংবাদপত্রে ধর্ষণবিরোধী প্রচারণা করতে হবে। নাটক, সিনেমাসহ বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠানে ধর্ষণদৃশ্য বাদ দিতে হবে।

৪। ধর্ষণ বিষয়ে সন্তানদের বোঝাতে হবে এটা অপরাধ। বিশেষত ছোট ছেলেদের এই বিষয়ে সম্যক ধারণা দিতে হবে।

৪। বিজ্ঞাপণে নারীদের পণ্য হিসেবে ব্যবহারের প্রথা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। যা শুধু নারী অবমাননাই নয় নারীদেরকে বস্তু ভাবতে প্রেরনা যোগায়।

৫। নীরব দর্শক হয়ে থাকা চলবে না। আমাদের আশেপাশে প্রতিনিয়ত মেয়েদের সাথে নানা ধরণের অনৈতিক কার্যকলাপ চলছে। এমন কিছু দেখলে সাথে সাথে প্রতিবাদ করতে হবে।

৬। রাষ্ট্র কর্তৃক দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

৭। পুরুষ মানুষ মাত্রই ধর্ষক বা সকল পুরুষকে সম্ভাব্য ধর্ষকের কাতারে ফেলে দিয়ে ধর্ষণকে পুরুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে।

৮। ধর্ষকদের কোনভাবে রাজনৈতিক ভাবে আশ্রয় বা প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না।

এরকম আরো উপায় থাকতে পারে যার মাধ্যমে ধর্ষণ প্রতিরোধ সম্ভব। আমাদের সাবধানতা এবং সচেতনতাই পারে ধর্ষণ প্রতিরোধ করতে।

রবিবার, ১১ অক্টোবর, ২০২০

সাপ লুডু খেলার ইতিহাস

খেলাটি আমারা সকলে খেলেছি। জীবনে এমন কোন ব্যাক্তিকে পাওয়া যাবে না যে একবার ও এই খেলাটি খেলেনি। খেলাটিকে আমরা বলে থাকি সাপ লুডু। ইংরেজিতে বলে থাকি Snakes and Ladders. 
শুনে অবাক হবেন যে এই খেলাটা যদিও ইংরেজদের খেলা বললেও সেটি কিন্তু আমাদের একটা প্রাচীন খেলা। এই উপমহাদেশের আবিস্কার। 


অনেক আগে ১৩শ শতাব্দীতে ঋষি জ্ঞানদেব মজার এই খেলাটি আবিষ্কার করেন, যা আজ আমরা সাপ ও মই খেলা বলে খেলি। প্রাচীনকালে এটি মোক্ষপথ নামে পরিচিত, এই খেলার একটি উল্লেখযোগ্য এবং গভীর অর্থ ছিল। সাপেরা ভাস্কর্য দেখিয়েছিল, যখন মই ভাল গুণাবলী প্রকাশ করেছিল। খেলার সারাংশ ছিল যে মই ভাল গুণাবলী লোকেদেরকে স্বর্গে নিয়ে যায় যখন সাপ অপকার মানুষকে পুনরায় জন্মের একটি চক্রের দিকে নিয়ে যায়। এমনকি দাবা প্রাচীন ভারতের একটি জনপ্রিয় খেলা ছিল।

ব্রিটিশরা যখন আমাদেরকে শাসন করে তখন তারা এই খেলাটি সম্পর্কে জানে এবং ১৮৯২ সালে এই খেলাটির রুপ একটু পরিবর্তন করে John Jacques।  ১৯৪৩ সালে ইংল্যান্ড থেকে খেলাটি আর একটু পরিবর্তন হয়ে  আমেরিকা পৌঁছায় Milton Bradley এর হাত ধরে। তখনি এই খেলার নতুন নাম হয় "সাপ ও মই" Snakes and Ladders. 

১৯৭৭ সালে দীপক সিংখাদা নামের এক যুবক শিকাগো শহরের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে বসে নেপাল এবং তিব্বতের বিভিন্ন ছবির সংগ্রহ তালিকা প্রস্তুত করছিলেন। এ সময় মিউজিয়ামের এক কোনে পড়ে থাকা এক অদ্ভুত ছবির ওপর তার দৃষ্টি চলে যায়। জাদুঘরের রেজিস্টারে ছবিটি নিয়ে শুধু বলা হয়েছে, ‘রিলিজিয়াস ওয়ার্ক’। 

ছবিটি এক ভারতীয় আর্ট ডিলারের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল বলে জানা যায়। ছবিটি দেখে দীপক বেশ অবাকই হয়। কারণ ছবির মধ্যে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহাদেবের উপস্থিতি। আর জাদুঘরে এ ধরনের বিষয় নিয়ে আর কোন ছবিই চোখে পড়েনি। নানা পুথিপত্র পড়ে দীপকের কাছে বিষয়টি কেবল ধর্মীয় বিষয় বলে মনে হলো না, কেবলই তার মনে হতে লাগলো এর সাথে অন্য কোনো বিষয় জড়িয়ে আছে। তিনি বুঝতে পারলেন, ছবিটি উত্তর ভারত থেকে সংগ্রহ করা হলেও এর মূল লুকিয়ে আছে নেপালে। তার এক পরিচিত অধ্যাপক দীপককে জানালেন, এ ধরণের একটি ছবি তিনি নেপালের জাদুঘরে দেখেছেন।

এই ছবির রহস্য উন্মোচনের জন্য দীপক রওনা হলেন নেপালে। নেপালে পৌঁছেই উপস্থিত হলেন নেপালের ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। মিউজিয়ামের রেজিস্টার ঘাঁটতে শুরু করলেন যদি এই বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়। রেজিস্টারে শিকাগো মিউজিয়ামে দেখা এমনই এক ছবির কথা বলা আছে। জাদুঘর থেকে সে চিত্রকর্মটি বের করা হলো। নেপালের ন্যাশনাল মিউজিয়ামে পাওয়া এই চিত্রপটের নাম 'নাগপাশ'।

এই চিত্রকর্ম সম্পর্কে পড়াশোনা করতে গিয়ে দীপক দেখেন এটি কোনো ধর্মীয় বিষয় নয়। এটি একটি খেলার ছক। নেপালিরা শুদ্ধ করে এ খেলাকে 'নাগপাশ' বললেও মুখে তারা বলেন ‘বৈকুন্ঠ খেল’। আসলে এটি আমাদের অতি পরিচিত এক খেলা ‘সাপ লুডু’।

নেপালে পাওয়া নাগপাশের ছকেও রয়েছে এই সাপ। তবে নাগপাশে দুই ধরনের সাপ দেখতে পাওয়া যায়। লাল সাপ আর কালো সাপ। লাল শুভ-লাভ এবং সৌভাগ্যের প্রতীক। কালো সাপ অশুভ এবং দুর্ভাগ্যের প্রতীক। নেপালি নাগপাশে লাল-সাপের লেজে গুটি পৌঁছতে পারলে খেলোয়াড়কে তা অনেক উঁচু জায়গায় পৌঁছে দেয়। আর কালো সাপের মাথায় গুটি পড়লে একেবারে লেজের শেষে নেমে যেতে হয়। 

আমরা যে সাপ-লুডু খেলি, তাতেও সাপের ব্যবহার আছে। এখানেও গুটি সাপের মাথায় পড়লে সাপের লেজের শেষে নেমে যেতে হয়। তবে এখানে উপরে উঠার জন্য লাল সাপের পরিবর্তে মই ব্যবহার করা হয়। আর তাই লাল সাপগুলো এখানে অনুপস্থিত। তবে এখনকার সাপ-লুডুতে কোথাও মই, কোথাও তীর আবার কোথাও রকেটও ব্যবহার করা হচ্ছে।

শুধু মজা পাওয়ার জন্য আমরা যেমন সাপ-লুডু খেলি, নাগপাশ খেলার উদ্দেশ্য ছিল তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।  নাগপাশ খেলার উদ্দেশ্য ছিল অনেক গভীর এবং তার সাথে কিছুটা ধর্মেরও যোগাযোগ আছে। প্রাচীনকালে এই খেলার মাধ্যমে একজন খেলোয়াড় তার কর্মফল পরিমাপ করতেন। ভালো কাজের ফল পুণ্য, মন্দ কাজের ফল পাপ। সেকালের মানুষরা বিশ্বাস করতো, মানুষের এই পাপ-পুণ্য বা শুভাশুভ ফল ভবিষ্যৎ জীবন এবং পরজন্মের জন্য সঞ্চিত হয়ে থাকে। তারা বিশ্বাস করতো, ভালো কাজ করলে স্বর্গ আর খারাপ কাজ করলে নরক ভোগ করতে হয়।

জীবিত অবস্থায় একজন মানুষ ভাল কাজ করছে না মন্দ কাজ করছে, তা নিয়ে একটা সন্দেহ তখনকার দিনের মানুষদের মধ্যে প্রবলভাবে ছিল। এই কর্মফলে বিশ্বাসী মানুষের ভাবনা থেকেই নাগপাশ খেলার জন্ম নেয়। আর সে সময়ের মানুষদের কাছে নাগপাশ হলো কর্মফল পরিমাপ করার এক মজার উপায়।

১৯৭৫ সালে হরিশ জোহারি নামের এক পণ্ডিতের লেখা বইতে দেখা যায়, নেপালের নাগপাশ খেলার প্রচলন দশম শতকে হলেও তার বহু আগে থেকেই ভারতেবর্ষে এই খেলার চল ছিল। ভারতের দিকে এর খেলার নাম ছিল ‘জ্ঞান-চৌপার’ বা ‘মোক্ষ-পতমু’, অনেকে সংক্ষেপে বলেন মোক্ষপথ। আর তখন ভারত বা নেপাল বলে আলাদা কোনো দেশ ছিল না। তবে কীভাবে এই খেলা ভারত থেকে নেপালে গেল, সে সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। জ্ঞান-চৌপারের খেলার উদ্দেশ্যও নাগপাশের মতোই। এখানেও ৭২টি খোপ। তবে এখানে লাল সাপের পরিবর্তে তীর বা বাণ ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীকালে যা মই বা সিঁড়ির চেহারা নিয়েছে। সাপ-লুডুর মধ্যে যে কর্মফল, আত্মজ্ঞানের কথা রয়েছে, সেসব প্রতীকি বিষয়গুলো হারিয়ে গিয়ে আজ তা নিছক খেলায় পরিণত হয়েছে। 

বিংশ শতাব্দীতে এসে সাপ-লুডু খেলাটি কোন নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারিদের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে তা সার্বজনীনতার রূপ পায়। ফলে খেলাটি বিভিন্ন বয়সী মানুষদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠে। বর্তমান সময়ে এসে ভিডিও গেমসের কল্যাণে এই ঐতিহাসিক ও জনপ্রিয় খেলাটি অনেকের মোবাইল ও কম্পিউটারে স্থান করে নিয়েছে। তাই কালের বিবর্তনে খেলাটিতে নানা পরিবর্তন আসলেও এর জনপ্রিয়তা আজও অমলিন।

রবিবার, ৩০ আগস্ট, ২০২০

মন্দির ও ঈশ্বরের সান্নিধ্য

মন্দির হল দেব-উপাসনার স্থান। ‘মন্দির’ বলতে বোঝায় ‘দেবতার গৃহ’। হিন্দু মন্দির এমন একটি আধ্যাত্মিক কেন্দ্র যেখানে মায়ার জগৎ থেকে মানুষ তীর্থযাত্রী বা পূণ্যার্থীর বেশে জ্ঞান ও সত্যের জগতের সন্ধানে আসেন। হিন্দু মন্দিরের প্রতীকতত্ত্ব ও গঠনভঙ্গিমা বৈদিক ঐতিহ্যের মধ্যেই নিহিত আছে। একটি মন্দিরের মধ্যে হিন্দু বিশ্বতত্ত্বের সকল ধারণার সন্ধান পাওয়া যায়। এরমধ্যে ভাল, মন্দ ও মানবিক দিকগুলির সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুর কালচক্র ধারণা এবং পুরুষার্থ ধারণার সব কিছুই প্রতীকের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ধর্ম, কাম, অর্থ, মোক্ষ, কর্ম ও ভক্তির দার্শনিক ধারণাগুলিও প্রতীকের মাধ্যমে মন্দিরে উপস্থিত থাকেহিন্দুধর্মের ভক্তিবাদী শাখায় মন্দির হল পূজার স্থান। পূজার মাধ্যমে ভক্তরা দেবতাকে শ্রদ্ধা জানান, ঈশ্বরকে ডাকেন এবং অধ্যাত্মচিন্তার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। হিন্দুধর্মের অন্যান্য শাখায় মন্দিরে ভক্তেরা জপ, ধ্যান, যোগ বা শাস্ত্রপাঠের মাধ্যমে সর্বোচ্চ উপাস্যের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন।

আমাদের মন্দিরে প্রবেশ করার আগে,আমাদের মন স্থির করতে হয়। আর আমরা যখন মন্দিরে প্রবেশ করি আমাদের মন শান্ত ও পবিত্র হয়ে যায়।

মন্দিরে প্রবেশের আগে আমাদের অবশ্যই স্নান করে পরিস্কার কাপড় পরিধান করতে হয়। মন্দিরে সব সময় ট্র্যাডিশনাল পোষাক পরিধান করে যাওয়া উচিত। যেমন- শাড়ি, পাঞ্জাবী, ধুতি ইত্যাদি যা আপনাকে মন্দিরের মেঝেতে বসে আরাধনা করতে সহায়তা করবে।

আমারা যখন মন্দিরে প্রবেশ করি আমাদের মনকে স্থির ও শান্ত করতে হয় এবং এই বিশ্বাস রাখতে যে, ঈশ্বর আমার আরাধনা গ্রহণ করবেন। বাহ্যিক চিন্তা সব মন থেকে ফেলে দিতে হয়।  মন্দিরে যাওয়ার সময় অবশ্যই আমাদের ঈশ্বরকে নিবেদনের জন্য ফল-মূল, ফুল, মোমবাতি , ধুপকাঠি নিয়ে যাওয়া উচিত। মন্দিরে প্রবেশ করে আমরা অনেকে হাত জোড় করে, মন্দির প্রদক্ষিণ করে ভগবানকে স্মরণ করেন।

তবে মন্দির দর্শনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল প্রণাম। পুরুষ ও নারীর প্রণামের পদ্ধতির মধ্যে কিছুটা আলাদা আছে। পুরুষেরা সাধারনত যেভাবে প্রাণাম করে তাকে বলা হয় অষ্টাঙ্গ প্রনাম। এতে তার দুই পা, বুক, কপাল, দুই হাটু ও দুই পা মোট আটটি অঙ্গ ভূমি স্পর্শ করবে। মহিলারা সাধারনত যেভাবে প্রাণাম করে তাকে বলা হয় পঞ্চাঙ্গ প্রনাম। এতে তার দুই পা, কপাল, দুই হাটু ও দুই পা মোট পাঁচটি অঙ্গ ভূমি স্পর্শ করবে। এই প্রণামের মধ্যে দিয়েই ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করা হয়।

মন্দিরে কেউ কেউ ভজন বা ভক্তিগীতি গানের মাধ্যমে, মন্ত্রের মাধ্যমে ঈশ্বরের আরাধনা করে থাকেন। অনেকে ধ্যানের মাধ্যমে ঈশ্বরের আরাধনা করেন।

হিন্দু মন্দিরের উদ্দেশ্য ব্যক্তির মনকে পবিত্র করা ও ভক্তের আত্মজ্ঞান জাগরিত বিভিন্ন হিন্দু মন্দিরের প্রধান দেবতা আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রের বৈচিত্র্যের পরিচায়ক।

হিন্দুধর্মে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় চেতনার মধ্যে কোনো বিভাজন নেই। তাই হিন্দু মন্দিরগুলি শুধুই যে  পবিত্র স্থান তাই নয়, ধর্মনিরপেক্ষ স্থানও বটে। যার কারনে অনেক মন্দির আধ্যাত্মিক জীবনের বাইরে সামাজিক রীতিনীতি ও দৈনিক জীবনের ক্ষেত্রেও প্রসারিত হয়ে এগুলিকে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রুপ নিয়েছে । কোনো কোনো মন্দির বিশেষ বিশেষ উৎসবের জন্য বিখ্যাত। সেখানে নৃত্য ও গীতের মাধ্যমে শিল্পের চর্চা করা হয়। তাছাড়া  বিবাহ,  অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ ইত্যাদির মতো সামাজিক অনুষ্ঠানও পালিত হয় অনেক মন্দিরে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের ক্ষেত্রেও হিন্দু মন্দির গুরুত্বপূর্ণ। অনেক হিন্দু রাজবংশের বংশপরম্পরার সঙ্গে হিন্দু মন্দিরের যোগাযোগ আছে। আবার আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কাজকর্মের সঙ্গেও অনেক হিন্দু মন্দির অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। 

সোমবার, ২৪ আগস্ট, ২০২০

ভালো থাকবেন হে বীর ! হে দেশপ্রেমিক ! বীরোত্তম চিত্ত রঞ্জন দত্ত

বীরোত্তম চিত্ত রঞ্জন দত্ত

.............খাওয়া-দাওয়া করে গ্রাম থেকে দুজন গাইড নিয়ে চললাম হিমুর উদ্দেশে। সারা রাত নদী-খাল-বিল পার হয়ে পৌঁছলাম আটগ্রাম বলে একটি গ্রামে। সেখান থেকে হিমুর দূরত্ব দুই মাইল। আটগ্রামে পৌঁছলাম ভোর চারটায়। গ্রামের পাশে নদী পার হতে হবে। ওপারে সবাই পৌঁছলাম। সকাল হতে চলেছে। দেখলাম হিমু পর্যন্ত পুরো মাঠ খোলা। চিন্তা করলাম দিনের বেলা এই খোলা মাঠের ভেতর দিয়ে যাওয়া সমীচীন হবে না।

যা-ই হোক আমরা সবাই আবার নদী পার হয়ে আটগ্রামে ফিরে এলাম। বেলা সাড়ে আটটা হবে। পাকিস্তানিদের দিক থেকে শুরু হলো গোলাবর্ষণ। একই সঙ্গে মেশিনগান ও এসএমজির গুলিবর্ষণ। কিছু করার নেই, একেবারে শত্রুর মুখে পড়ে গেছি। আটগ্রাম ছোট গ্রাম। বৃষ্টির মতো গোলাগুলি হচ্ছিল। চিন্তা করলাম যদি আটগ্রামে থাকি সবাই মারা যাব। তাই সবাইকে বললাম, যে যেভাবে পারে পেছনে যেতে। ......

পরে সেখানে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। তিনি অত্যন্ত ধৈর্য্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেন। তাঁর প্রেরণায় মুক্তিযোদ্ধারা যথেষ্ট সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন।

যেই বীর সন্তানের কথা বললাম তিনি হলেন বীরোত্তম চিত্ত রঞ্জন দত্ত (সি আর দত্ত)। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার। তিনি ৪নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত হন।

চিত্ত রঞ্জন দত্তের জন্ম ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি আসামের শিলংয়ে। তার পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশি গ্রামে। তার বাবার নাম উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত এবং মায়ের নাম লাবণ্য প্রভা দত্ত। শিলং-এর 'লাবান গভর্নমেন্ট হাইস্কুল' -এ দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন৷ পরবর্তীকালে বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে হবিগঞ্জে এসে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন৷ হবিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে ১৯৪৪ সালে তিনি মাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তীতে কলকাতার আশুতোষ কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হয়ে ছাত্রাবাসে থাকা শুরু করেন তিনি৷ পরবর্তীতে খুলনার দৌলতপুর কলেজের বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হন৷ পরে এই কলেজ থেকেই বি.এস.সি পাশ করেন৷

১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সীমান্ত রক্ষা প্রহরী গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সরকার৷ এই বিষয়ে চিত্ত রঞ্জন দত্তকে দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ সরকার৷ পরবর্তীকালে তিনি সীমান্ত রক্ষা প্রহরী গঠন করেন এবং নাম দেন বাংলাদেশ রাইফেলস। বর্তমানে এ বাহিনীর নাম বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ। চিত্ত রঞ্জন দত্ত ছিলেন বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম ডাইরেক্টর জেনারেল। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি হেড কোয়ার্টার চিফ অব লজিস্টিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ ১৯৭৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন৷ ১৯৭৯ সালে বি আর টি সি এর চেয়ারম্যান হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮২ সালে তিনি পুনরায় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন৷ ১৯৮৪ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন৷

“আমার সরকার, আমার জনগণ যেন এক থাকেন” এই কথা বলার মত বীর সেনা আজ পাড়ি দিয়েছেন দূর অজানায় না ফেরার দেশে।

বীরোত্তম চিত্ত রঞ্জন দত্ত, সি আর দত্ত আপনাকে স্যালুট। ভালো থাকবেন হে বীর ! হে দেশপ্রেমিক !

শুক্রবার, ২১ আগস্ট, ২০২০

বাচ্চাদের যে ৫টি গুণাবলী ভগবান গণেশের কাছ থেকে শেখার আছে

আমরা আজ গণেশ চতুর্থী উদযাপন করছি এবং হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী আপনি আপনার বাচ্চাদের ভগবান গনেশের তাৎপর্য এবং মাহাত্ম্য শেখানোর সময় এসেছে। প্রিয় ভগবান গণেশের কাছ থেকে শেখার মতো প্রচুর শিক্ষা রয়েছে। গনেশকে এমন অনেক গুণাবলী আছে যা একটি শিশু জীবন গঠনে সহায়তা করতে পারে। তাই বাচ্চাদের ঐতিহ্য এবং ভগবান গণেশের উপাসনার গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষিত করা পিতা-মাতার দায়িত্ব। নিচে গণেশের কয়েকটি নৈতিক পাঠ নিয়ে আলোচনা করলাম যা আপনাকে আপনার সন্তানের ভাল মূল্যবোধ শেখাতে সহায়তা করবে । এটি আপনার ছোট বাচ্চাদের এবং অন্যান্য মায়ের সাথেও ভাগ করতে মিস করবেন না।

 

স্বাধীনচেতা হওয়াঃ

ভগবান গণেশ হলেন একটি স্বতন্ত্র দেবতা, যার নেতৃত্বের দুর্দান্ত গুণ রয়েছে। গণেশের অপর নাম বিনায়ক এর অর্থ হল যার কোন নেতা নেই। তাই  আপনার বাচ্চাদের স্বাধীন হতে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জন করতে শেখান!

 

বিনয়ী হওয়াঃ

যদিও হিন্দু দেবদেবীদের মধ্যে গনেশের অনন্য তাৎপর্য রয়েছে, তবে তাঁর বাহনটি বিনয়ী - ইঁদুর। এটি গণেশের বিনয়ী হওয়াকে প্রতিফলিত করে। সরলতা দ্বারা সকলের মন জয় করা যায় এবং সম্মান অর্জন করা যায়। সম্পদ, জ্ঞান অর্জনের জন্য আপনার বাচ্চাদের নম্র হতে শেখান।

 

একজন ভাল শ্রোতা হওয়াঃ

গণেশের অন্যতম বিখ্যাত গুণ ' তার বড় কান। যা তাকে ভাল শ্রোতা করে তোলে। একজন ভাল শ্রোতা হওয়ার কারনে তাকে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। কথা বলার আগে শুনুন। বাবা-মা হিসাবে, আপনাকেও অবশ্যই আপনার বাচ্চার কথা শুনতে হবে, এতে করে আপনার সন্তানেরা আপনার কথা শুনবে। অপ্রয়োজনে আপনার বাচ্চাদের ডাকবেন না । সর্বদা তাদের  চিন্তা-ভাবনা গুলোর গুরুত্বদিন । তাদের দেখান যে আপনি সত্যই তাদের কথা শোনেন। আপনার বাচ্চাদের সঠিক কিছু শেখানোজন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণকারন বাচ্চারা অনুকরন প্রিয় আর  তারা আপনার কাছ থেকে এটি শিখবে।

 

জ্ঞান অর্জন করাঃ 

ভগবান গণেশের বড় মাথার কারনে মহাবিশ্বের অনেকগুলি বিষয়কে বোঝার এবং বোঝার দক্ষতা আছে। কথায় আছে  "জ্ঞানই শক্তি"। তাই আপনার বাচ্চাদের আরও জ্ঞান এবং বুদ্ধি অর্জনের জন্য বিশ্বকে  আরও ভাল করে জানার ও বোঝার জন্য উৎসাহীত করুন।

 

অন্যের প্রতি সমবেদনা প্রকাশঃ

গনেশের দেহ মানব, যখন মাথাটি একটি হাতির। কেবলমাত্র মানুষেরই হৃদয় আবেগে ভরপুর থাকে। আপনার বাচ্চাদের স্নেহময় হতে শেখান এবং তাদের চারপাশে প্রেম এবং সুখ ছড়িয়ে দিতে বলুন।


আজ, যখন আমরা গণেশ চতুর্থী উদযাপন করি এবং তাঁর আশীর্বাদ কামনা করিআসুন আমরা উদযাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ভগবান গণেশ থেকে আমাদের বাচ্চাদের কিছু দুর্দান্ত মূল্যবোধ শিক্ষা দিই এবং তাদের জীবনে চলার জন্য তাদের  ভাল ব্যক্তি করে গড়ে তুলি।


------------------------------------------------শুভ গণেশ চতুর্থী ---------------------------------------------

বৃহস্পতিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২০

শুক্লাম্বর দীঘির ইতিহাস- জানুন

মা অসুস্থ অনেক দিন ধরে, ঘর থেকে কোথাও বের হতে পারে না। 

সেদিন মাকে বললাম , - মা! চলো শুক্লাম্বর দীঘি দর্শন করে আসি।

মা বললেন- চল, ঘুরে আসি।

আমারো অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল শুক্লাম্বর দীঘি দর্শন করা।

সেদিন ছিল আগস্টের ২ তারিখ রবিবার। আমার অফিসে তখন ঈদের ছুটি চলছিল। আগের দিন রাতে পাশের বাসার লিটন কাকার সহায়তাই গাড়িও ঠিক হয়ে গেল। মন্দিরে যাব শুনে মামা ভাই অর্ক ও বোন ঐশী চলে আসল রাতে ১১টায় বাসায়। ঘুম থেকে উঠেই শুনতে লাগলাম বাবার বকা। তারাতাড়ি কর, দেরী হয়ে যাচ্ছে। অবশেষে সকাল ১০টাই পরিবারের ১২ সদস্যকে নিইয়ে যাত্রা শুরু করলাম শুক্লাম্বর দীঘির উদ্দেশ্যে। মইজ্যারটেক নেমে পূজার জন্য ফল-মূল কিনলাম।

তারপর ফোন দিলাম মন্দিরের অসীম দাদাকে। আমাদের সকলের জন্য মন্দিরে প্রসাদের ব্যবস্থা করার জন্য। তিই বললেন দাদা কোন চিন্তা করবেন না। আপনি মন্দিরে এসে শুধু আমাকে ফোন করবেন।

অবশেষে মন্দিরে পোঁছালাম বেলা সাড়ে ১১টার দিকে। দীঘিতে স্নান সেরে মন্দিরের পুজা দিলাম। পুজার পর মন্দিরের ব্রাহ্মনের সাথে বসে মন্দিরের ইতিহাস শুনলাম। শুনে অবাক হলাম। তাই গুগোল সার্চ করা আপনাদের জন্য শুক্লাম্বর দীঘির ইতিহাসটা তুলে ধরলাম!

মন্দিরের সামনের ছবি

 শুক্লাম্বর দীঘির ইতিহাস

চন্দনাইশ থানার দক্ষিণে শঙ্খনদীর তীরবর্তী বাইনজুরি মৌজার সুচিয়া গ্রামে শ্রী শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য্যের শ্রীপাট ত্রিপুরা সুন্দরী দেবীর মন্দির দীঘি ও আশেপাশেরবিশাল জায়গা নিয়ে এ শ্রী পাটের পত্তন হয় প্রায় পাঁচশো বছর আগে। ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে নবদ্বীপ থেকে শ্রী শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য্য এখানে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন বৈদিক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ। তাঁর পূর্ব পুরুষেরা মিথিলা থেকে এসে প্রথমে সিলেটের পঞ্চখণ্ডে বসতি স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা চিরকাল সেখানে ছিলেন না। বিদ্যার্জনের জন্য তাঁরা নবদ্বীপ চলে গিয়েছিলেন। বিদ্যা ও জ্ঞানের জন্য তখন প্রসিদ্ধ ছিল নবদ্বীপ। শ্রী শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য্যের ছিল একান্নবর্তী বৃহৎ পরিবার। তাছাড়া ভক্ত সেবক ও অনুচরের সংখ্যাও কিন্তু কম ছিল না। তাঁর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন তাঁর স্ত্রী,একপুত্র রামচন্দ্র ও এক কন্যামহামায়া। তর্কবাগীশ ও সিদ্ধান্ত বাগীশ নামে পণ্ডিত দু’ভাই এবং তাঁদের নিকট পরিজনেরা। তিন ভাইয়ের মধ্যে শ্রী শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য ছিলেন বড়। তিনি সঙ্গতিপন্ন ছিলেন। তাই এখানে একলা কিংবা সঙ্গোপনে আসতে পারেননি। পথ দুর্গম হলেও তিনি সপরিবারে রাজার মতো এসেছিলেন। তবে নবদ্বীপ থেকে তাঁর এতখানি অধ্যবসায় সাপেক্ষে এতদূর আসার পিছনে হয়তো ধর্মবিপ্লবই ছিল প্রধান কারণ। নবদ্বীপে তখন শাক্ত- বৈষ্ণব ধর্মের দ্বন্দ্ব প্রবল। শ্রী শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য্য ছিলেন মাতৃভাবনার সাধক।হয়তো সাধনার জন্য বিবাদ,বিপদ,বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয়ের পথ পরিহার করে তিনি এ প্রত্যন্ত প্রদেশে সরে এসেছিলেন।

একান্নবর্তী পরিবারের কর্তা হলেও তাঁর মধ্যে ছিল এক গভীর নিরাসক্তি। বিবেক,বৈরাগ্য ও ভক্তি তাঁকে সংসারে সন্ন্যাসী করে তুলেছিল। তিনি ছিলেন শক্তি উপাসক। অষ্টাদশ মহাবিদ্যার অন্তর্গত ত্রিপুরা সুন্দরী ছিলেন তাঁর ইষ্টদেবী। সুচিয়া গ্রামে এসে বসতি স্থাপনের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি খনন করিয়েছিলেন একবড় দীঘি। দীঘির পাড়ে অশ্বত্থ বট আর পাকুড়ের ছায়ায় তিনি ইষ্টদেবীর জন্য একটি ছোট মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।

মন্দিরে পুজার স্থান

আর মন্দিরের অদূরে তৈরি করেছিলেন তাঁর সাধন মঠ। এ মঠে তিনি সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। কথিত আছে এ মঠেই দেবী ত্রিপুরা সুন্দরী সাক্ষাৎ আবির্ভূতা হয়ে তাঁকে সাধনার সিদ্ধিফল প্রদান করেছিলেন। সাক্ষাৎ দেবতাদর্শন করে তিনি মানব জন্ম অতিক্রম করেছিলেন। সাধনার সিদ্ধিফল তিনি উৎসর্গ করেছিলেন লোক কল্যাণে। তাই এখনো শ্রী শুক্লাম্বরের প্রতিষ্ঠিত মাতৃমন্দির ও দীঘি লোকমুক্তির বাণী প্রচার করছে। তাঁর তো আকাঙক্ষার অন্তহয়েছিল কিন্তু মানুষের অনন্ত আকাঙক্ষা তিনি প্রতিদিন পূরণ করেন তাঁর যা কিছু মাহাত্ম্যের প্রচার দীঘিটি নিয়ে। যে মঠে তাঁর ইষ্টদেবী দর্শন হলো তা নয় দীঘিটি ঘিরে তাঁর অনেক অলৌকিক কাহিনী শোনা যায়। যেমনদীঘির জল কখনো শুকায় না। কেউ এ দীঘি পারাপার করতে পারে না। উত্তরায়ণ সংক্রান্তিতে এ। দীঘিতে স্নান করলে গঙ্গাস্নানের ফল হয়।যে শঙ্খ নদীর অববাহিকায় এ দীঘির অবস্থান তার প্লাবনের জলও কখনো প্রবেশ করেনি। অবশ্য এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক কিংবদন্তী। কাহিনীটি এ রকম শ্রাবণের কোন এক ঘন বর্ষণের ভোরে খরস্রোতা প্রলয়ঙ্করী শঙ্খনদী এ দিঘীতে ঢুকবে পণ করে প্রবল বেগে আছড়ে পড়েছিল পাড়ে। মঠের ধ্যানাসনে উপবিষ্ট শ্রী শুক্লাম্বর হাতে কমন্ডলুটি নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন।এ প্রবল স্রোতের মুখে। তিনি দীঘির জল অপবিত্র হবে ভেবে নদীকে ফিরে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। নদীর জল দীঘিতে ঢুকলে দীঘির জল অপবিত্র হওয়ার আশঙ্কা ছিল। কারণ নদীর স্রোতে ভেসে এসেছিলএকটি মরা গরু। ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে এ সাধক হাতের কমন্ডলুর জল ছিটিয়ে দিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন মরা গরুটি। প্রাণ পেয়ে সেইটি গিয়েদাঁড়িয়েছিল উঁচু ডাঙায়। মুহূর্তে স্থির হয়ে গিয়েছিল উমত্ত জলরাশি। জল থেকে উঠে এসেছিলেন মকর বাহনা গঙ্গা। তিনি বর দিয়েছিলেন যে শঙ্খ নদীর জল কোনদিন দীঘিতে প্রবেশকরবে না। শ্রী শুক্লাম্বরও জানিয়েছিলেন দেবীর আবির্ভাবের স্মারক হিসেবে দীঘির পাড়ের এ অংশটি কখনো আর আগের মতো হবে না। আর তা দেখে যুগে যুগে লোকমুখে প্রচারিত হবে এ দেব।সম্মিলনের কাহিনী। এখনো দীঘির পাড়ের ঐ অংশটি ভাঙা। ঠিক করলেও ঠিক।থাকে না। সাধকের বাক্য এখনো ভক্তের প্রত্যক্ষগোচর হয়। শ্রী শুক্লাম্বরের এ অলৌকিক লীলা প্রত্যক্ষ করেছিলেন যোশীরাম। যোশীরাম তাঁর সেবক। ছায়ার মতো নিত্যসঙ্গী। যোশীরাম এ লীলা প্রত্যক্ষ করেধন্য হয়েছিলেন। তিনিই তা প্রচার করেছিলেন। এ যোশীরাম মনে হয় বাঙালি ছিলেন না। দীর্ঘদিন তাঁর প্রভুর সঙ্গে থেকে এদেশীয় সবকিছু আয়ত্ত করেছিলেন। সিদ্ধি লাভের পরে ইষ্ট দর্শনে শ্রী শুক্লাম্বরের সংসারের প্রতি বন্ধন শিথিল হয়ে পড়েছিল। তাই তাঁর বৃহৎ পরিবারের ভরণ পোষণ,অতিথি আশ্রিতের প্রতিপালন করতেন তাঁর পুত্র ও ভাইয়েরা। তিনি পরিব্রাজকের জীবন যাপন করতেন। ত্রিপুরার রাজ বাড়িতে তাঁর গুরুর মর্যাদা।ছিল। ত্রিপুরার রাজা নিজেদের চিত্রকর দিয়ে শ্রী শুক্লাম্বরের একটি তৈলচিত্র অঙ্কন করেছিলেন। ছবিটি দীর্ঘদিন ত্রিপুরার রাজবাড়িতে ছিল। হয়তো আরও নানাজায়গায় তাঁরনানা স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। কোন দিন তা লোকচক্ষুর গোচর হবে।

দীঘির পাড়ে অশ্বত্থ বট 

শ্রী শুক্লাম্বরের ছোট দু’ভাইছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত। তাঁরাও বড় ভাই এর মতো দু’টো বড় বড় দীঘি খনন করে তা মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। তার একটি আছে শ্রী শুক্লাম্বর এর দীঘির অদূরে। তর্কবাগীশের দীঘি। অন্যটি তাঁদের বসত বাড়ির কাছে সিদ্ধান্তবাগীশের দীঘি। শ্রী শুক্লাম্বরের একটি পরিবার কালক্রমে বহু শরীকে বিভক্ত হয়ে একটি পাড়ায় পরিণত হয়েছে। তাও অনেকে কার্যোপলক্ষ্যে স্থানান্তরে গিয়েছেন বলে। শ্রী শুক্লাম্বরের মন্দিরের পুজোর ভার তাঁর বংশধরদের। তাঁরা সুদিনে যেমন দুর্দিনেও শুক্লাম্বরকে তাঁদের রক্ত সম্পর্কীয় মনে করে সেবা করেন।এমন কি স্বাধীনতা সংগ্রামের মতো ঘোরতর রাষ্ট্র বিপ্লবের।সময়ও তাঁরা নিত্যপুজোটি বজায় রেখেছিলেন। ভগবান শুক্লাম্বরের সঙ্গে আত্মীয় সম্বন্ধের জন্য তাঁরা বংশগত সেবায়েত। তাই তাঁদের দায়িত্ব যেমন ভিন্ন দায়ও বেশি। এ তীর্থের সঙ্গে অন্যান্য আশ্রম মন্দিরের মৌলিক তফাৎ এখানেই। শ্রী শুক্লাম্বরের উত্তর পুরুষদের মধ্যে অনেকে উপাধিকারী পণ্ডিত ও শাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন। তাঁদের কারও কারও টোল বা চতুষপটী ছিল। এদেশে আবির্ভূত খুব বেশি মহাপুরুষের বংশধারা নেই। কিন্তু যেখানে আছে সে তীর্থস্থানের মাহাত্ম্য মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য আলাদা।

দিঘীর অপরপ্রান্ত থেকে তোলা ছবি

ভগবান শুক্লাম্বরের দীঘি ও সাধন পীঠের প্রসিদ্ধি বহুদূর বিস্তৃত। এ রকম সচরাচর দেখা যায় না। এখানে শ্রী শুক্লাম্বরের মনোবাসনাপূর্ণহয়েছিল বলে ‘বাঞ্ছা কল্পতরু’ তাঁর আশীর্বাদে সকলের বাঞ্ছাপূরণ হয়। তাই দূর- দূরান্তের দেশ-বিদেশের ভক্তেরা সারা বছর আসেন। সবচেয়ে বেশি সমাগম হয় উত্তরায়ণ সংক্রান্তির সময়। এ সময় তিনদিন মেলা বসে। এ মেলাটি প্রাচীন। শ্রী শুক্লাম্বরের অমর্ত্য জীবন লীলা যে পুঁথিতে লিপিবদ্ধ ছিলবলে জানা যায় তার নাম ‘শুক্লাম্বর-তরঙ্গিনী’। শ্রী শুক্লাম্বরের ভক্ত ও অনুরাগী নিত্যানন্দ বৈদ্য নামে একজন এপুঁথির কোন কোন অংশ নাকি গান করে শোনাতেন। বোঝা যায় এ সাধকের জীবন কথা ও নানা কাহিনী এ ভাবে ক্রমে ক্রমে লোকমুখে প্রচারিত হয়েছে। আর কিছু কিছু তাঁর বংশধরদের মুখ থেকে মানুষের জানবার সুযোগ হয়েছে। শ্রী শুক্লাম্বরের সাধনপীঠে তাঁর সমাধি নেই। হয়তো তিনি অন্য কোথাও দেহ রেখেছিলেন। সমাধি তিনি যেখানেই লাভ করুন এ সাধনপীঠ তাঁর লীলাস্থান।

মন্দিরে আমার পরিবার

ভক্তের ভক্তি অহৈতুকী। তাই ভক্তের বিশ্বাস সম্মানযোগ্য। এ তীর্থক্ষেত্রের সবখানে ভগবান শুক্লাম্বরের চরণ পাতা রয়েছে ভক্তেরা মনে করেন।