বৃহস্পতিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২০

শুক্লাম্বর দীঘির ইতিহাস- জানুন

মা অসুস্থ অনেক দিন ধরে, ঘর থেকে কোথাও বের হতে পারে না। 

সেদিন মাকে বললাম , - মা! চলো শুক্লাম্বর দীঘি দর্শন করে আসি।

মা বললেন- চল, ঘুরে আসি।

আমারো অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল শুক্লাম্বর দীঘি দর্শন করা।

সেদিন ছিল আগস্টের ২ তারিখ রবিবার। আমার অফিসে তখন ঈদের ছুটি চলছিল। আগের দিন রাতে পাশের বাসার লিটন কাকার সহায়তাই গাড়িও ঠিক হয়ে গেল। মন্দিরে যাব শুনে মামা ভাই অর্ক ও বোন ঐশী চলে আসল রাতে ১১টায় বাসায়। ঘুম থেকে উঠেই শুনতে লাগলাম বাবার বকা। তারাতাড়ি কর, দেরী হয়ে যাচ্ছে। অবশেষে সকাল ১০টাই পরিবারের ১২ সদস্যকে নিইয়ে যাত্রা শুরু করলাম শুক্লাম্বর দীঘির উদ্দেশ্যে। মইজ্যারটেক নেমে পূজার জন্য ফল-মূল কিনলাম।

তারপর ফোন দিলাম মন্দিরের অসীম দাদাকে। আমাদের সকলের জন্য মন্দিরে প্রসাদের ব্যবস্থা করার জন্য। তিই বললেন দাদা কোন চিন্তা করবেন না। আপনি মন্দিরে এসে শুধু আমাকে ফোন করবেন।

অবশেষে মন্দিরে পোঁছালাম বেলা সাড়ে ১১টার দিকে। দীঘিতে স্নান সেরে মন্দিরের পুজা দিলাম। পুজার পর মন্দিরের ব্রাহ্মনের সাথে বসে মন্দিরের ইতিহাস শুনলাম। শুনে অবাক হলাম। তাই গুগোল সার্চ করা আপনাদের জন্য শুক্লাম্বর দীঘির ইতিহাসটা তুলে ধরলাম!

মন্দিরের সামনের ছবি

 শুক্লাম্বর দীঘির ইতিহাস

চন্দনাইশ থানার দক্ষিণে শঙ্খনদীর তীরবর্তী বাইনজুরি মৌজার সুচিয়া গ্রামে শ্রী শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য্যের শ্রীপাট ত্রিপুরা সুন্দরী দেবীর মন্দির দীঘি ও আশেপাশেরবিশাল জায়গা নিয়ে এ শ্রী পাটের পত্তন হয় প্রায় পাঁচশো বছর আগে। ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে নবদ্বীপ থেকে শ্রী শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য্য এখানে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন বৈদিক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ। তাঁর পূর্ব পুরুষেরা মিথিলা থেকে এসে প্রথমে সিলেটের পঞ্চখণ্ডে বসতি স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা চিরকাল সেখানে ছিলেন না। বিদ্যার্জনের জন্য তাঁরা নবদ্বীপ চলে গিয়েছিলেন। বিদ্যা ও জ্ঞানের জন্য তখন প্রসিদ্ধ ছিল নবদ্বীপ। শ্রী শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য্যের ছিল একান্নবর্তী বৃহৎ পরিবার। তাছাড়া ভক্ত সেবক ও অনুচরের সংখ্যাও কিন্তু কম ছিল না। তাঁর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন তাঁর স্ত্রী,একপুত্র রামচন্দ্র ও এক কন্যামহামায়া। তর্কবাগীশ ও সিদ্ধান্ত বাগীশ নামে পণ্ডিত দু’ভাই এবং তাঁদের নিকট পরিজনেরা। তিন ভাইয়ের মধ্যে শ্রী শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য ছিলেন বড়। তিনি সঙ্গতিপন্ন ছিলেন। তাই এখানে একলা কিংবা সঙ্গোপনে আসতে পারেননি। পথ দুর্গম হলেও তিনি সপরিবারে রাজার মতো এসেছিলেন। তবে নবদ্বীপ থেকে তাঁর এতখানি অধ্যবসায় সাপেক্ষে এতদূর আসার পিছনে হয়তো ধর্মবিপ্লবই ছিল প্রধান কারণ। নবদ্বীপে তখন শাক্ত- বৈষ্ণব ধর্মের দ্বন্দ্ব প্রবল। শ্রী শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য্য ছিলেন মাতৃভাবনার সাধক।হয়তো সাধনার জন্য বিবাদ,বিপদ,বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয়ের পথ পরিহার করে তিনি এ প্রত্যন্ত প্রদেশে সরে এসেছিলেন।

একান্নবর্তী পরিবারের কর্তা হলেও তাঁর মধ্যে ছিল এক গভীর নিরাসক্তি। বিবেক,বৈরাগ্য ও ভক্তি তাঁকে সংসারে সন্ন্যাসী করে তুলেছিল। তিনি ছিলেন শক্তি উপাসক। অষ্টাদশ মহাবিদ্যার অন্তর্গত ত্রিপুরা সুন্দরী ছিলেন তাঁর ইষ্টদেবী। সুচিয়া গ্রামে এসে বসতি স্থাপনের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি খনন করিয়েছিলেন একবড় দীঘি। দীঘির পাড়ে অশ্বত্থ বট আর পাকুড়ের ছায়ায় তিনি ইষ্টদেবীর জন্য একটি ছোট মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।

মন্দিরে পুজার স্থান

আর মন্দিরের অদূরে তৈরি করেছিলেন তাঁর সাধন মঠ। এ মঠে তিনি সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। কথিত আছে এ মঠেই দেবী ত্রিপুরা সুন্দরী সাক্ষাৎ আবির্ভূতা হয়ে তাঁকে সাধনার সিদ্ধিফল প্রদান করেছিলেন। সাক্ষাৎ দেবতাদর্শন করে তিনি মানব জন্ম অতিক্রম করেছিলেন। সাধনার সিদ্ধিফল তিনি উৎসর্গ করেছিলেন লোক কল্যাণে। তাই এখনো শ্রী শুক্লাম্বরের প্রতিষ্ঠিত মাতৃমন্দির ও দীঘি লোকমুক্তির বাণী প্রচার করছে। তাঁর তো আকাঙক্ষার অন্তহয়েছিল কিন্তু মানুষের অনন্ত আকাঙক্ষা তিনি প্রতিদিন পূরণ করেন তাঁর যা কিছু মাহাত্ম্যের প্রচার দীঘিটি নিয়ে। যে মঠে তাঁর ইষ্টদেবী দর্শন হলো তা নয় দীঘিটি ঘিরে তাঁর অনেক অলৌকিক কাহিনী শোনা যায়। যেমনদীঘির জল কখনো শুকায় না। কেউ এ দীঘি পারাপার করতে পারে না। উত্তরায়ণ সংক্রান্তিতে এ। দীঘিতে স্নান করলে গঙ্গাস্নানের ফল হয়।যে শঙ্খ নদীর অববাহিকায় এ দীঘির অবস্থান তার প্লাবনের জলও কখনো প্রবেশ করেনি। অবশ্য এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক কিংবদন্তী। কাহিনীটি এ রকম শ্রাবণের কোন এক ঘন বর্ষণের ভোরে খরস্রোতা প্রলয়ঙ্করী শঙ্খনদী এ দিঘীতে ঢুকবে পণ করে প্রবল বেগে আছড়ে পড়েছিল পাড়ে। মঠের ধ্যানাসনে উপবিষ্ট শ্রী শুক্লাম্বর হাতে কমন্ডলুটি নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন।এ প্রবল স্রোতের মুখে। তিনি দীঘির জল অপবিত্র হবে ভেবে নদীকে ফিরে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। নদীর জল দীঘিতে ঢুকলে দীঘির জল অপবিত্র হওয়ার আশঙ্কা ছিল। কারণ নদীর স্রোতে ভেসে এসেছিলএকটি মরা গরু। ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে এ সাধক হাতের কমন্ডলুর জল ছিটিয়ে দিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন মরা গরুটি। প্রাণ পেয়ে সেইটি গিয়েদাঁড়িয়েছিল উঁচু ডাঙায়। মুহূর্তে স্থির হয়ে গিয়েছিল উমত্ত জলরাশি। জল থেকে উঠে এসেছিলেন মকর বাহনা গঙ্গা। তিনি বর দিয়েছিলেন যে শঙ্খ নদীর জল কোনদিন দীঘিতে প্রবেশকরবে না। শ্রী শুক্লাম্বরও জানিয়েছিলেন দেবীর আবির্ভাবের স্মারক হিসেবে দীঘির পাড়ের এ অংশটি কখনো আর আগের মতো হবে না। আর তা দেখে যুগে যুগে লোকমুখে প্রচারিত হবে এ দেব।সম্মিলনের কাহিনী। এখনো দীঘির পাড়ের ঐ অংশটি ভাঙা। ঠিক করলেও ঠিক।থাকে না। সাধকের বাক্য এখনো ভক্তের প্রত্যক্ষগোচর হয়। শ্রী শুক্লাম্বরের এ অলৌকিক লীলা প্রত্যক্ষ করেছিলেন যোশীরাম। যোশীরাম তাঁর সেবক। ছায়ার মতো নিত্যসঙ্গী। যোশীরাম এ লীলা প্রত্যক্ষ করেধন্য হয়েছিলেন। তিনিই তা প্রচার করেছিলেন। এ যোশীরাম মনে হয় বাঙালি ছিলেন না। দীর্ঘদিন তাঁর প্রভুর সঙ্গে থেকে এদেশীয় সবকিছু আয়ত্ত করেছিলেন। সিদ্ধি লাভের পরে ইষ্ট দর্শনে শ্রী শুক্লাম্বরের সংসারের প্রতি বন্ধন শিথিল হয়ে পড়েছিল। তাই তাঁর বৃহৎ পরিবারের ভরণ পোষণ,অতিথি আশ্রিতের প্রতিপালন করতেন তাঁর পুত্র ও ভাইয়েরা। তিনি পরিব্রাজকের জীবন যাপন করতেন। ত্রিপুরার রাজ বাড়িতে তাঁর গুরুর মর্যাদা।ছিল। ত্রিপুরার রাজা নিজেদের চিত্রকর দিয়ে শ্রী শুক্লাম্বরের একটি তৈলচিত্র অঙ্কন করেছিলেন। ছবিটি দীর্ঘদিন ত্রিপুরার রাজবাড়িতে ছিল। হয়তো আরও নানাজায়গায় তাঁরনানা স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। কোন দিন তা লোকচক্ষুর গোচর হবে।

দীঘির পাড়ে অশ্বত্থ বট 

শ্রী শুক্লাম্বরের ছোট দু’ভাইছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত। তাঁরাও বড় ভাই এর মতো দু’টো বড় বড় দীঘি খনন করে তা মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। তার একটি আছে শ্রী শুক্লাম্বর এর দীঘির অদূরে। তর্কবাগীশের দীঘি। অন্যটি তাঁদের বসত বাড়ির কাছে সিদ্ধান্তবাগীশের দীঘি। শ্রী শুক্লাম্বরের একটি পরিবার কালক্রমে বহু শরীকে বিভক্ত হয়ে একটি পাড়ায় পরিণত হয়েছে। তাও অনেকে কার্যোপলক্ষ্যে স্থানান্তরে গিয়েছেন বলে। শ্রী শুক্লাম্বরের মন্দিরের পুজোর ভার তাঁর বংশধরদের। তাঁরা সুদিনে যেমন দুর্দিনেও শুক্লাম্বরকে তাঁদের রক্ত সম্পর্কীয় মনে করে সেবা করেন।এমন কি স্বাধীনতা সংগ্রামের মতো ঘোরতর রাষ্ট্র বিপ্লবের।সময়ও তাঁরা নিত্যপুজোটি বজায় রেখেছিলেন। ভগবান শুক্লাম্বরের সঙ্গে আত্মীয় সম্বন্ধের জন্য তাঁরা বংশগত সেবায়েত। তাই তাঁদের দায়িত্ব যেমন ভিন্ন দায়ও বেশি। এ তীর্থের সঙ্গে অন্যান্য আশ্রম মন্দিরের মৌলিক তফাৎ এখানেই। শ্রী শুক্লাম্বরের উত্তর পুরুষদের মধ্যে অনেকে উপাধিকারী পণ্ডিত ও শাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন। তাঁদের কারও কারও টোল বা চতুষপটী ছিল। এদেশে আবির্ভূত খুব বেশি মহাপুরুষের বংশধারা নেই। কিন্তু যেখানে আছে সে তীর্থস্থানের মাহাত্ম্য মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য আলাদা।

দিঘীর অপরপ্রান্ত থেকে তোলা ছবি

ভগবান শুক্লাম্বরের দীঘি ও সাধন পীঠের প্রসিদ্ধি বহুদূর বিস্তৃত। এ রকম সচরাচর দেখা যায় না। এখানে শ্রী শুক্লাম্বরের মনোবাসনাপূর্ণহয়েছিল বলে ‘বাঞ্ছা কল্পতরু’ তাঁর আশীর্বাদে সকলের বাঞ্ছাপূরণ হয়। তাই দূর- দূরান্তের দেশ-বিদেশের ভক্তেরা সারা বছর আসেন। সবচেয়ে বেশি সমাগম হয় উত্তরায়ণ সংক্রান্তির সময়। এ সময় তিনদিন মেলা বসে। এ মেলাটি প্রাচীন। শ্রী শুক্লাম্বরের অমর্ত্য জীবন লীলা যে পুঁথিতে লিপিবদ্ধ ছিলবলে জানা যায় তার নাম ‘শুক্লাম্বর-তরঙ্গিনী’। শ্রী শুক্লাম্বরের ভক্ত ও অনুরাগী নিত্যানন্দ বৈদ্য নামে একজন এপুঁথির কোন কোন অংশ নাকি গান করে শোনাতেন। বোঝা যায় এ সাধকের জীবন কথা ও নানা কাহিনী এ ভাবে ক্রমে ক্রমে লোকমুখে প্রচারিত হয়েছে। আর কিছু কিছু তাঁর বংশধরদের মুখ থেকে মানুষের জানবার সুযোগ হয়েছে। শ্রী শুক্লাম্বরের সাধনপীঠে তাঁর সমাধি নেই। হয়তো তিনি অন্য কোথাও দেহ রেখেছিলেন। সমাধি তিনি যেখানেই লাভ করুন এ সাধনপীঠ তাঁর লীলাস্থান।

মন্দিরে আমার পরিবার

ভক্তের ভক্তি অহৈতুকী। তাই ভক্তের বিশ্বাস সম্মানযোগ্য। এ তীর্থক্ষেত্রের সবখানে ভগবান শুক্লাম্বরের চরণ পাতা রয়েছে ভক্তেরা মনে করেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন