বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০১১

মনসা- নারী থেকে দেবী নাকি নিন্ম থেকে উচ্চবর্ণের হিন্দু দের দেবীতে পরিণত হওয়া দেব শক্তি?

হিন্দুধর্মে মনসা লৌকিক সর্পদেবী। তাঁর পূজা প্রধানত বাংলাউত্তর ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে প্রচলিত। সর্পদংশন প্রতিরোধ ও সাপের বিষের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁর পূজা করা হয়। মনসা প্রজনন ও সমৃদ্ধিরও দেবী। তিনি নাগরাজ বাসুকীর ভগিনী ও ঋষি জগৎকারু বা জরৎকারুর পত্নী। মনসা বিষহরি (বিষনাশকারিণী), জগৎগৌরী, নিত্যা (চিরন্তনী) ও পদ্মাবতী নামেও পরিচিতা।
পুরাণ ও লোককথা অনুযায়ী, পিতা শিব ও স্বামী জগৎকারু উভয়েই মনসাকে প্রত্যাখ্যান করেন। সৎ-মা চণ্ডী (এই ক্ষেত্রে পার্বতীর নামান্তর) তাঁকে ঘৃণা করেন। এই কারণে মনসা সর্বদা নিরানন্দ ও বদরাগী। অন্য এক মতে, মনসার পিতা হলেন কশ্যপ। মনসা তাঁর ভক্তদের ভালবাসেন। কিন্তু যে তাঁর পূজা করতে অস্বীকার করে, তার প্রতি তিনি নির্দয় হন। প্রথম দিকে দেবতারা মনসার দেবীত্ব স্বীকার করেননি। এই কারণে মনসাকে নিজে উদ্যোগী হয়ে দেবী হিসেবে তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হয় এবং নিজেকেই নিজের পূজা প্রচার করে মানব ভক্তমণ্ডলীতে স্থান খুঁজে নিতে হয়।

উৎস

মনসা মূলত একজন আদিবাসী দেবতা। নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের মধ্যে তাঁর পূজা প্রচলিত ছিল। পরবর্তীকালে উচ্চবর্ণীয় হিন্দুসমাজেও মনসা পূজা প্রচলন লাভ করে। বর্তমানে মনসা আর আদিবাসী দেবতা নন, বরং তিনি একজন হিন্দু দেবীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। হিন্দু দেবী হিসেবে তাঁকে নাগ বা সর্পজাতির পিতা কশ্যপ ও মাতা কদ্রুর সন্তান রূপে কল্পনা করা হয়েছে। খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দী নাগাদ, মনসাকে শিবের কন্যারূপে কল্পনা করে তাঁকে শৈবধর্মের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই সময় থেকেই প্রজনন ও বিবাহরীতির দেবী হিসেবেও মনসা স্বীকৃতি লাভ করেন। কিংবদন্তি অনুযায়ী, শিব বিষপান করলে মনসা তাঁকে রক্ষা করেন; সেই থেকে তিনি বিষহরি নামে পরিচিতা হন। তাঁর জনপ্রিয়তা দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত প্রসারিত হয়। মনসার পূজকেরা শৈবধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেও অবতীর্ণ হন। শিবের কন্যারূপে মনসার জন্মকাহিনি এরই ফলস্রুতি। এর পরেই হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদী মূলধারায় মনসা দেবীরূপে স্বীকৃতিলাভ করেন।

মূর্তিতত্ত্ব

একাদশ শতাব্দীর মনসা ভাস্কর্য
মনসা সর্বাঙ্গে সর্পাভরণভূষিতা এবং পদ্ম অথবা নাগপৃষ্ঠে আসীনা। তাঁর মাথার উপর সপ্তফণাযুক্ত নাগছত্র দেখা যায়। কখনো কখনো তাঁর কোলে একটি শিশুকেও দেখা যায়। মনে করা হয় এটি তাঁর পুত্র আস্তিক। মনসাকে "একচক্ষু কানা" (চাঁদ সদাগরের বিখ্যাত উক্তি অনুযায়ী, "চেঙমুড়ী কানী") দেবীও বলা হয়। কারণ তাঁর একটি চোখ সৎ-মা চণ্ডী কর্তৃক দগ্ধ হয়েছিল।

মহাভারত

মহাভারতে মনসার বিবাহের কাহিনিটি রয়েছে। ঋষি জগৎকারু এক প্রচণ্ড তপস্যায় রত ছিলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে বিবাহ করবেন না। একদা তিনি দেখতে পান যে একদল লোককে গাছে উলটো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এঁরা ছিলেন তাঁরই পূর্বপুরুষ। তাঁদের সন্তানেরা তাঁদের শ্রাদ্ধাদি সম্পূর্ণ না করায় তাঁদের এই দুঃখজনক অবস্থা হয়েছিল। তাঁরা জগৎকারুকে বিবাহ করার উপদেশ দিয়ে বলেন যে তাঁর পুত্রই শ্রাদ্ধাদি সম্পূর্ণ করে তাঁদের দুঃখ থেকে মুক্তি দিতে পারবে। বাসুকী জগৎকারুর সঙ্গে নিজ ভগিনী মনসার বিবাহ দেন। আস্তিক নামে তাঁদের একটি পুত্রসন্তান হয়। আস্তিক তাঁর পূর্বপুরুষদের মুক্তি দেন। রাজা জনমেজয় সর্পজাতির বিনাশার্থে সর্পনিধন যজ্ঞ শুরু করলে আস্তিকই নাগদের রক্ষা করেন।

পুরাণ

মনসার জন্মকাহিনি প্রথম উল্লিখিত হয়েছে পুরাণগ্রন্থেই। মঙ্গলকাব্যে তাঁকে শিবের কন্যা বলা হলেও, পুরাণ অনুসারে তিনি ঋষি কশ্যপের কন্যা। একদা সর্প ও সরীসৃপগণ পৃথিবীতে কলহ শুরু করলে কশ্যপ তাঁর মন থেকে মনসার জন্ম দেন। ব্রহ্মা তাঁকে সর্প ও সরীসৃপদের দেবী করে দেন। মনসা মন্ত্রবলে বিশ্বের উপর নিজ কর্তৃত্ব স্থাপন করেন। এরপর মনসা শিবের সঙ্গে সন্ধিস্থাপন করেন। শিব তাঁকে কৃষ্ণ-আরাধনার উপদেশ দেন। মনসা কৃষ্ণের আরাধনা করলে কৃষ্ণ তুষ্ট হয়ে তাঁকে সিদ্ধি প্রদান করেন এবং প্রথামতে তাঁর পূজা করে মর্ত্যলোকে তাঁর দেবীত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
কশ্যপ জরুৎকারুর সঙ্গে মনসার বিবাহ দেন। মনসা তাঁর অবাধ্যতা করলে, তিনি মনসাকে ত্যাগ করবেন – এই শর্তে জরুৎকারু মনসাকে বিবাহ করেন। একদা মনসা দেরি করে তাঁর নিদ্রাভঙ্গ করলে তাঁর পূজায় বিঘ্ন ঘটে। এই অপরাধে জরুৎকারু মনসাকে ত্যাগ করেন। পরে দেবতাদের অনুরোধে তিনি মনসার কাছে ফিরে আসেন এবং আস্তিক নামে তাঁদের একটি পুত্রসন্তান জন্মায়।

মঙ্গলকাব্য

পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চলের একটি গ্রামে মনসার মূর্তি
মঙ্গলকাব্য হল খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে বাংলায় রচিত মনসা ও অন্যান্য স্থানীয় দেবদেবীর মাহাত্ম্যসূচক গাথাকাব্য। বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলবিপ্রদাস পিপলাইয়ের মনসাবিজয় কাব্যে মনসার জন্ম ও অন্যান্য উপাখ্যানগুলি সম্পূর্ণ বর্ণিত হয়েছে।
মনসাবিজয় কাব্য থেকে জানা যায়, বাসুকীর মা একটি ছোটো মেয়ের মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। শিবের বীর্য এই মূর্তি স্পর্শ করলে মনসার জন্ম হয়। বাসুকী তাঁকে নিজ ভগিনীরূপে গ্রহণ করেন। রাজা পৃথু পৃথিবীকে গাভীর ন্যায় দোহন করলে উদগত বিষের দায়িত্বও বাসুকী মনসাকে দেন। শিব মনসাকে দেখে কামার্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু মনসা প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে তিনি শিবেরই কন্যা। শিব তখন মনসাকে স্বগৃহে আনয়ন করেন। শিবের পত্নী চণ্ডী মনসাকে শিবের উপপত্নী মনে করেন। তিনি মনসাকে অপমান করেন এবং ক্রোধবশত তাঁর একটি চোখ দগ্ধ করেন। পরে শিব একদা বিষের জ্বালায় কাতর হলে মনসা তাঁকে রক্ষা করেন। একবার চণ্ডী তাঁকে পদাঘাত করলে তিনি তাঁর বিষদৃষ্টি হেনে চণ্ডীকে অজ্ঞান করে দেন। শেষে মনসা ও চণ্ডীর কলহে হতাশ হয়ে শিব মনসাকে পরিত্যাগ করেন। দুঃখে শিবের চোখ থেকে যে জল পড়ে সেই জলে জন্ম হয় মনসার সহচরী নেতার।
পরে জরৎকারুর সঙ্গে মনসার বিবাহ হয়। কিন্তু চণ্ডী মনসার ফুলশয্যার রাতটিকে ব্যর্থ করে দেন। তিনি মনসাকে উপদেশ দিয়েছিলেন সাপের অলঙ্কার পরতে আর বাসরঘরে ব্যাঙ ছেড়ে রাখতে যাতে সাপেরা আকর্ষিত হয়ে তাঁর বাসরঘরে উপস্থিত হয়। এর ফলে, ভয় পেয়ে জরৎকারু পালিয়ে যান। পরে তিনি ফিরে আসেন এবং তাঁদের পুত্র আস্তিকের জন্ম হয়।
মনসামঙ্গল কাব্যের একটি পটচিত্র
এরপর মনসা তাঁর সহচরী নেতার সঙ্গে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন মানব ভক্ত সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে। প্রথম দিকে লোকেরা তাঁকে ব্যঙ্গ করে। কিন্তু যারা তাকে পূজা করতে অস্বীকার করে, তাদের চরম দুরবস্থা সৃষ্টি করে তাদের পূজা আদায় করেন মনসা। তিনি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের পূজা লাভে সক্ষম হন। এমনকি মুসলমান শাসক হাসানও তাঁর পূজা করেন। কিন্তু শিব ও চণ্ডীর পরমভক্ত চাঁদ সদাগর তাঁর পূজা করতে অস্বীকার করেন। চাঁদের পূজা আদায়ের জন্য মনসা চাঁদের ছয় পুত্রকে হত্যা করেন এবং তাঁকে নিঃস্ব করে দেন। পরে তিনি চাঁদের কনিষ্ঠ পুত্র লখিন্দরকে হত্যা করলে, তাঁর বিধবা পুত্রবধূ বেহুলা চাঁদকে মনসা পূজায় রাজি করাতে সক্ষম হন। চাঁদ মনসার দিকে না তাকিয়ে বাম হাতে তাঁকে ফুল ছুঁড়ে দেন। মনসা তাতেই খুশি হয়ে চাঁদের ছয় পুত্রকে জীবিত করেন এবং তাঁর সকল সম্পত্তি ফিরিয়ে দেন। এরপরই মনসা পূজা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
মনসামঙ্গলে বলা হয়েছে, পূর্বজন্মে চাঁদকে মনসা একটি অভিশাপ দিয়েছিলেন। তার পাল্টা অভিশাপে মনসার ভক্ত সংগ্রহে অসুবিধা হতে থাকে। কারণ এই শাপে বলা হয়েছিল, চাঁদ মনসার পূজা না করলে মর্ত্যে মনসার পূজা প্রচলন লাভ করবে না।
আনন্দ কে. কুমারস্বামীভগিনী নিবেদিতা লিখেছেন, "[The] legend of [Chand Sadagar and] Manasā Devī, [...] who must be as old as the Mykenean stratum in Asiatic society, reflects the conflict between the religion of Shiva and that of female local deities in Bengal. Afterwards Manasā or Padmā was recognized as a form of Shakti, [...] and her worship accepted by Shaivas. She is a phase of the mother-divinity who for so many worshippers is nearer and dearer than the far-off and impersonal Shiva...".

পূজা

অধিকাংশ ক্ষেত্রে, প্রতিমায় মনসা পূজা করা হয় না। মনসা পূজিতা হন স্নুহী বা সীজ বৃক্ষের ডালে অথবা বিশেষভাবে সর্পচিত্রিত ঘট বা ঝাঁপিতে। যদিও কোথাও কোথাও মনসা মূর্তিরও পূজা হয়। বাংলায় মনসা পূজা বহুল প্রচলিত। এই অঞ্চলে মনসার মন্দিরও দেখা যায়। বর্ষাকালে সাপেদের প্রাদুর্ভাব বেশি থাকে বলে এই সময়ই মনসা পূজা প্রচলিত। শ্রাবণ মাসে নাগপঞ্চমীতেও মনসার পূজা করা হয়। বাঙালি মেয়েরা এই দিন উপবাস ব্রত করে সাপের গর্তে দুধ ঢালেন।

এখন আপ্নারাই বিচার করবেন- যে ইনি - নারী থেকে দেবী নাকি নিন্ম থেকে উচ্চবর্ণের হিন্দু দের দেবীতে পরিণত হওয়া দেব শক্তি?

মঙ্গলবার, ১৬ আগস্ট, ২০১১

বেদে কোনো বর্ণভেদ নেই

এটা ভীষণ দুর্ভাগ্যজনক যে, যে বিশ্বের হিন্দু সম্প্রদায়ে বেদ হলো সমাজের মূল ভিত্তি, সেখানে আমরা ভুলেই গেছি বেদের মূল শিক্ষাগুলো এবং নিজেদেরকে নানা ভুল-ভ্রান্তিসমূহের ধারণায় জড়িয়ে ফেলেছি যেমন, জন্মগত caste system-সহ নানারকম বৈষম্য। এরকম বিপথগামী চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা আমাদের সমাজকে ভীষণ ক্ষতিসাধন করেছে এবং বৈষম্যের সূত্রপাত ঘটিয়ে দিয়েছে। Dalit নামক জাতিচ্যুত ব্যক্তিদের আমরা দূরে ঠেলে দিয়েছি এবং এর ফলে আমাদের উন্নতি ও প্রগতির বিকাশ স্থবির হচ্ছে। এর একমাত্র সমাধান হচ্ছে হিন্দু সমাজের মূলে গিয়ে বেদকে জানা - যার ফলে আমরা আমাদের মধ্যে ভাঙা সম্পর্কগুলো পুনরায় স্থাপণ করতে পারব।

এই লেখায় আমরা চেষ্টা করব বেদ অনুযায়ী আমাদের caste system সম্পর্কে প্রকৃত ইতিহাস উদঘাটন করার এবং শূদ্রের আসল অর্থ খোঁজার।

১। প্রথমত, কোনো প্রকার হিংসা বা বৈষম্যের স্থাণ নেই বেদে যেকোনো ব্যক্তি সম্পর্কে - সে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, বা শূদ্র কিনা।

২। Caste system প্রায় নতুন। বেদে কোনো শব্দ নেই যার অর্থ বর্ণ/জাতি হতে পারে। আসলে, caste, জাতি আর বর্ণ এগুলো এক একটি এক এক অর্থ বহন করে। 

Caste- হলো একটি ইউরোপীয় নবধারা যার সাথে বৈদিক সংস্কৃতির কোনো সামঞ্জস্যতা নেই।

জাতি - 'জাতি'র অর্থ হচ্ছে এক শ্রেণীভুক্তকরণ যার উৎস হচ্ছে জন্মে। ন্যায় সূত্র বলেছে "সমানপ্রসাভাত্মিকা জাতিহ্‌" অথবা তারা যাদের একইপ্রকার জন্মসূত্র যা এদেরকে একটি জাতিতে সমষ্টিবদ্ধ করে।
একটি প্রাথমিক আরো বড় শ্রেণীভুক্তকরণ ঋষিদের দ্বারা করা হয়েছে চারভাবে: উদ্ভিজ (অর্থাৎ গাছপালা), আন্ডাজ (অর্থাৎ ডিম থেকে যার উৎপত্তি যেমন পাখি এবং সরীসৃপ), পিন্ডজ (স্তন্যপায়ী), উষ্মজ (তাপমাত্রা বা পরিবেষ্টনকারী আবহাওয়ার জন্য যার জন্ম যেমন ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া ইত্যাদি)।
তেমনিভাবে নানাপ্রকার পশুসমূহ যেমন হাতি, সিংহ, খরগোশ ইত্যাদি তৈরি করে এক ভিন্ন 'জাতি'। একইভাবে সমস্ত মানবকুল তৈরি করে একটি 'জাতি'।
একটি নির্দিষ্ট জাতির থাকবে একই ধরনের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য যারা সেই জাতি থেকে আরেক জাতিতে পরিবর্তিত হতে পারবে না এবং ভিন্ন জাতির বাচ্চা প্রসব করতে পারবে না। অর্থাৎ, জাতি হচ্ছে ঈশ্বরের সৃষ্টি।
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রেরা কোনোভাবেই ভিন্ন জাতি নয় কারণ তাদের মধ্যে জন্ম সূত্রগত বা বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যগত কোনো পার্থক্য নেই যা তাদেরকে ভিন্ন করবে।
পরবর্তীতে 'জাতি' শব্দটি ব্যবহৃত হতে শুরু করে যেকোনো প্রকার শ্রেণীভেদকরণের জন্য। তাই সাধারণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা ভিন্ন ভিন্ন সমাজকেও ভিন্ন ভিন্ন 'জাতি' হিসেবে আখ্যা দেই। কিন্তু এ শুধু ব্যবহারের সুবিধার জন্য। আসলে আমরা মানবকুল এক জাতিরই অংশ।

বর্ণ - প্রকৃত যে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র বোঝাতে তা হলো 'বর্ণ' ('জাতি' নয়)।  'বর্ণ' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এই চারকে বোঝাতেই নয়, বরং দস্যু ও আর্যদেরকেও।

'বর্ণ' অর্থ হচ্ছে তাহাই যাহা গ্রহণ করা হয় পছন্দের দ্বারা। তাই, যেখানে 'জাতি' ঈশ্বর দ্বারা প্রদত্ত, 'বর্ণ' হচ্ছে আমাদের নিজস্ব পছন্দগত। 

যারা আর্য হতে পছন্দ করে তাদের বলা হয় 'আর্য বর্ণ'। তেমনি যারা দস্যু হতে পছন্দ করে, তারা হয় 'দস্যু বর্ণ'। একইভাবে হয় ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র।

এই কারণেই বৈদিক ধর্মকে বলা হয় 'বর্ণাশ্রম ধর্ম'। বর্ণ শব্দটি ইঙ্গিত করে যে এটির ভিত্তি হচ্ছে নিজ পছন্দকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া ও যোগ্যতা অনুসারে পরিচালিত ব্যবস্থাকে অনুমোদন দেয়া।

৩। যারা বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত, তারা পছন্দ করেন 'ব্রাহ্মণ বর্ণ'। যারা প্রতিরক্ষা, যুদ্ধ-বিগ্রহ পছন্দ করেন, তারা হন 'ক্ষত্রিয় বর্ণ'। যারা অর্থনীতি ও পশুপালনাদি পছন্দ করেন তারা হন 'বৈশ্য বর্ণ' এবং যারা নিয়োজিত আছেন অন্যান্য সেবামূলক কাজ-কর্মে, তারা হন 'শূদ্র বর্ণ'। এসব শুধু বোঝায় নানা ধরনের পছন্দ যেসব মানুষজন তাদের কর্মের জন্য নির্বাচন করেন এবং এর সাথে 'জাতি' বা জন্মের কোনো সম্পর্ক নেই।

৪।  পুরুষ সুক্তের অন্যান্য মন্ত্রসমূহ উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেছে যে, ব্রাহ্মণ এসেছে ঈশ্বরের মুখ থেকে, ক্ষত্রিয় হাত থেকে, বৈশ্য উরু থেকে এবং শূদ্র পা থেকে। সেইভাবে এইসব বর্ণসমূহ জন্মগত। কিন্তু কোনোকিছুই এর চেয়ে বেশী ভ্রান্তিজনক হতে পারে না। আসুন দেখি কেন:

(ক)  বেদ ঈশ্বরকে বর্ণনা করে আকারহীন ও অপরিবর্তনশীল হিসেবে। এমন ঈশ্বর কিভাবে বিশাল আকৃতির মানুষের রূপ ধারণ করতে পারে যদি তিনি আকারহীনই হন? (যজুর্বেদ ৪০.৮)

(খ)  যদি ইহা সত্যিই হয়, তাহলে তাহা বেদের কর্মতত্ত্বের বিরোধীতা করবে। কারণ কর্মতত্ত্ব অনুযায়ী, একজন ব্যক্তির জন্মগত পরিবার পরিবর্তিত হতে পারে তার কর্ম অনুসারে। সুতরাং একজন ব্যক্তি যে শূদ্র পরিবারে জন্ম নেয়, পরের জন্মে এক রাজার পরিবারে জন্ম নিতে পারে। কিন্তু যদি শূদ্রেরা ঈশ্বরের পা থেকে এসে থাকে, তাহলে সেই একই শূদ্র ঈশ্বরের হাত থেকে কিভাবে জন্ম নেয়?

(গ) আত্মা হলো সময়হীন এবং কখনো জন্ম নেয় না। সুতরাং আত্মার কখনোই কোনো বর্ণ হতে পারে না। এ শুধুমাত্র যখন আত্মা জন্ম নেয় মনুষ্য হিসেবে তখনই এর সুযোগ থাকে বর্ণ বেছে নেবার। তাহলে বর্ণ দ্বারা কি বোঝানো হয় যা ঈশ্বরের একাংশ হতে আসে? যদি আত্মা ঈশ্বরের দেহ থেকে জন্ম না নিয়ে থাকে, তাহলে কি এই বোঝায় যে আত্মার দেহ তৈরি হয়েছে ঈশ্বরের দেহের অংশ থেকে? কিন্তু বেদ অনুযায়ী, এমনকি প্রকৃতিও চিরন্তন। এবং এই একই অনু-পরমানু পুনর্ব্যবহৃত হচ্ছে নানা মনুষ্যের মধ্যে। তাই কৌশলগতভাবে ঈশ্বরের দেহ থেকে জন্ম নেয়া কারো পক্ষে অসম্ভব, এমনকি আমরা যদি ধরেও নেই ঈশ্বরের দেহ আছে।

(ঘ)  উপরে উল্লেখ করা পুরুষ সুক্ত রয়েছে যজুর্বেদের ৩১তম অধ্যায়ে (এবং ঋগবেদ ও অথর্ববেদ বাদে যেগুলোতে কিছু ভিন্নতা রয়েছে। যজুর্বেদে এ হচ্ছে ৩১.১১)। প্রকৃতভাবে এর অর্থ কি তা বোঝার জন্য, আসুন দেখি এর আগের মন্ত্রের দিকে লক্ষ্য করি ৩১.১০।
এতে প্রশ্ন করা হয়েছে - কে মুখ? কে হাত? কে উরু আর কেই বা পা?
এর পরের মন্ত্র এর উত্তর দিয়েছে - ব্রাহ্মণ হলো মুখ, ক্ষত্রিয় হলো হাত, বৈশ্য হলো উরু এবং শূদ্র হলো পা।
লক্ষ্য করুন, মন্ত্রটি কিন্তু বলছে না ব্রাহ্মণ "জন্ম নেয়" মুখ থেকে...এটি বলছে ব্রাহ্মণ "হলো" মুখ।
কারণ যদি মন্ত্রটির অর্থ হতো "জন্ম নেওয়া" তাহলে এটি উত্তর দিত না আগের মন্ত্রের প্রশ্নটির "কে মুখ?"
যেমন, যদি আমি প্রশ্ন করি "দশরথ কে?" উত্তরটি যদি হয় "রাম জন্ম নেন দশরথের ঘরে" তাহলে তা হবে অর্থহীন।

প্রকৃত অর্থ হচ্ছে:
সমাজে ব্রাহ্মণ বা বুদ্ধিজীবিরা তৈরি করে মস্তিষ্ক বা মাথা বা মুখ যা চিন্তা করে এবং বলে। ক্ষত্রিয় বা রক্ষণকর্মীরা তৈরি করে হাত যা রক্ষা করে। বৈশ্য বা উৎপাদনকারীরা এবং ব্যবসায়ীরা তৈরি করে উরু যা ভার বহন করে এবং যত্ন করে (লক্ষ্য করুন উরুর হাড় অথবা উর্বাস্থি তৈরি করে রক্ত এবং এ হচ্ছে দেহের সবচেয়ে শক্ত হাড়)। অথর্ববেদে উরুর বদলে "মধ্য" শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে যার অর্থ বোঝায় পাকস্থলী এবং দেহের মধ্যের অংশ।

শূদ্র বা শ্রমিকেরা তৈরি করে পা যা কাঠামোটিকে দাঁড় করায় এবং দেহকে চলতে সক্ষম করে।
পরবর্তী মন্ত্রগুলো আলোচনা করেছে অন্যান্য দেহের অংশ সম্পর্কে যেমন - মন, চোখ ইত্যাদি। পুরুষ সুক্ত বর্ণনা করেছে সৃষ্টির সূত্রপাত এবং তার স্থায়ী থাকা সম্পর্কে যার মধ্যে অন্তর্গত মানব সমাজ এবং বর্ণনা করেছে অর্থপূর্ণ সমাজের উপাদানসমূহকে।
তাই এ ভীষণ করুণ অবস্থা যে এমন সুন্দর সমাজ সম্পর্কে রূপক বর্ণনা এবং সৃষ্টি সম্পর্কিত বর্ণনা বিকৃত হয়েছে যা সম্পূর্ণভাবে বৈদিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে।
এমনকি ব্রহ্ম গ্রন্থগুলো, মনুস্মৃতি, মহাভারত, রামায়ণ এবং ভগবদগীতা বলে নাই কোনোকিছুই যার কাছাকাছি উপপ্রমেয় হতে পারে এমন অদ্ভূত যে ঈশ্বর তৈরি করেছেন ব্রাহ্মণদের তাঁর মুখ হতে মাংস ছিঁড়ে কিংবা ক্ষত্রিয়দের তাঁর হাতের মাংস থেকে বা অন্যান্যসমূহ।

৫। তাই এটি স্বাভাবিক কেন ব্রাহ্মণরা বেদ অনুসারে সবচেয়ে বেশী সম্মান লাভ করেছে। এমনটিই হচ্ছে আজকের বর্তমান সমাজে। বুদ্ধিজীবিরা এবং অভিজ্ঞরা আমাদের সম্মান অর্জন করেন কারণ তারা তৈরি করেন দিক প্রদর্শনকারী সারা মানবতার জন্য। কিন্তু যেমনভাবে পূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, বেদে শ্রমের মর্যাদা সমভাবে জোর দেওয়া হয়েছে এবং এই কারণেই কোনো প্রকার বৈষম্যের উপাদান নেই।

৬। বৈদিক সংস্কৃতিতে সবাইকে ধরা হয় শূদ্র হিসেবে জন্ম। তারপর ব্যক্তির শিক্ষা-দীক্ষা দ্বারা সে পরিণত হয় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যতে। এই শিক্ষা-দীক্ষার পূর্ণতাকে ধরা হয় দ্বিতীয় জন্ম। একারণেই এই তিন বর্ণকে বলা হয় "দ্বিজ" বা দু'জন্মা। কিন্তু যারা রয়ে যায় অশিক্ষিত (যেকোনো কারণেই হোক) তারা সমাজ থেকে বিচ্যুত হয়। তারা চালিয়ে যায় শূদ্র হিসেবে এবং করে যায় সমাজের সেবামূলক কাজসমূহ।

৭। এক ব্রাহ্মণের পুত্র, যদি সে তার শিক্ষা-দীক্ষা সম্পূর্ণ করতে অসমর্থ হয়, পরিণত হয় শূদ্রে। তেমনিভাবে শূদ্রের পুত্র অথবা এমনকি দস্যু, যদি সে তার শিক্ষা-দীক্ষা সম্পূর্ণ করে, তাহলে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় কিংবা বৈশ্য হতে পারে। এ হচ্ছে নির্ভেজাল যোগ্যতা অনুযায়ী ব্যবস্থা। যেমনভাবে এখনকার সময়ে ডিগ্রী প্রদান করা হয়, যজ্ঞপবিত দেয়া হতো বৈদিক নিয়ম অনুসারে। তাছাড়া, আচরণবিধির সাথে অসম্মতি ঘটলে যজ্ঞপবিত নিয়ে নেয়া হতো বর্ণগুলোর।

৮। বৈদিক ইতিহাসে অনেক উদাহরণ রয়েছে বর্ণ পরিবর্তনের -

(ক)  ঋষি ঐতরেয়া ছিলেন দাস বা অপরাধীর পুত্র কিন্তু তিনি পরিণত হন শীর্ষ ব্রাহ্মণদের মধ্যে একজন এবং লেখেন ঐতরেয়া ব্রহ্ম এবং ঐতরেয়াপোনিষদ। ঐতরেয়া ব্রহ্মকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরা হয় ঋগবেদ বোঝার জন্য।

(খ)  ঋষি ঐলুশ জন্মেছিলেন দাসীর ঘরে যিনি ছিলেন জুয়াখোর এবং নিচু চরিত্রের লোক। কিন্তু এই ঋষি ঋগবেদের উপর গবেষণা করেন এবং কিছু বিষয় আবিষ্কার করেন। তিনি শুধুমাত্র ঋষিদের দ্বারা আমন্ত্রিতই হতেন না এমনকি আচার্য্য হিসেবেও অধিষ্ঠিত হন। (ঐতরেয়া ব্রহ্ম ২.১৯)

(গ)  সত্যকাম জাবাল ছিলেন এক পতিতার পুত্র যিনি পরে একজন ব্রাহ্মণ হন।

(ঘ)  প্রীষধ ছিলেন রাজা দক্ষের পুত্র যিনি পরে শূদ্র হন। পরবর্তীতে তিনি তপস্যা দ্বারা মোক্ষলাভ করেন প্রায়ঃশ্চিত্তের পরে। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.১.১৪)
যদি তপস্যা শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ হতো যেমনভাবে উত্তর রামায়ণের নকল গল্প বলে, তাহলে প্রীষধ কিভাবে তা করল?

(ঙ)  নবগ, রাজা নেদিস্থের পুত্র পরিণত হন বৈশ্যে। তার অনেক পুত্র হয়ে যান ক্ষত্রিয়। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.১.১৩)

(চ)  ধৃষ্ট ছিলেন নবগের (বৈশ্য) পুত্র কিন্তু পরে ব্রাহ্মণ হন এবং তার পুত্র হন ক্ষত্রিয়। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.২.২)

(ছ)  তার পরবর্তী প্রজন্মে কেউ কেউ আবার ব্রাহ্মণ হন। (বিষ্ণু পুরাণ ৯.২.২৩)

(জ) ভগবদ অনুসারে অগ্নিবেশ্য ব্রাহ্মণ হন যদিও তিনি জন্ম নেন এক রাজার ঘরে।

(ঝ) রাথোটর জন্ম নেন ক্ষত্রিয় পরিবারে এবং পরে ব্রাহ্মণ হন বিষ্ণু পুরাণ ও ভগবদ অনুযায়ী।

(ঞ) হরিৎ ব্রাহ্মণ হন ক্ষত্রিয়ের ঘরে জন্ম নেয়া সত্ত্বেও। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.৩.৫)

(ট) শৌনক ব্রাহ্মণ হন যদিও ক্ষত্রিয় পরিবারে জন্ম হয়। (বিষ্ণু পুরাণ ৪.৮.১)
এমনকি বায়ু পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ ও হরিবংশ পুরাণ অনুযায়ী শৌনক ঋষির পুত্রেরা সকল বর্ণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
একই ধরনের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় গ্রীতসমদ, বিতব্য ও বৃৎসমতির মধ্যে।

(ঠ) মাতঙ্গ ছিলেন চন্ডালের পুত্র কিন্তু পরে ব্রাহ্মণ হন।

(ড) রাবণ জন্মেছিলেন ঋষি পুলৎস্যের ঘরে কিন্তু পরে রাক্ষস হন।

(ঢ)  প্রবৃদ্ধ ছিলেন রাজা রঘুর পুত্র কিন্তু পরে রাক্ষস হন।

(ণ)  ত্রিশঙ্কু ছিলেন একজন রাজা যিনি পরে চন্ডাল হন।

(ত)  বিশ্বামিত্রের পুত্রেরা শূদ্র হন। বিশ্বামিত্র নিজে ছিলেন ক্ষত্রিয় যিনি পরে ব্রাহ্মণ হন।

(থ)  বিদুর ছিলেন এক চাকরের পুত্র কিন্তু পরে ব্রাহ্মণ হন এবং হস্তিনাপুর রাজ্যের মন্ত্রী হন।


৯। "শূদ্র" শব্দটি বেদে দেখা গেছে প্রায় ২০ বারের মতো। কোথাও এটি অবমাননাকরভাবে ব্যবহৃত হয়নি। কোথাও বলা হয়নি শূদ্রেরা হলো অস্পর্শযোগ্য, জন্মগতভাবে এই অবস্থাণে, বেদ শিক্ষা হতে অনুনোমোদিত, অন্যান্য বর্ণের তুলনায় নিম্ন অবস্থাণের, যজ্ঞে অনুনোমোদিত।

১০। বেদে বলা হয়েছে শূদ্র বলতে বোঝায় কঠিন পরিশ্রমী ব্যক্তি। (তপসে শূদ্রম্‌ - যজুর্বেদ ৩০.৫)
একারণেই পুরুষ সুক্ত এদের বলে পুরো মানব সমাজের কাঠামো।

১১।  যেহেতু বেদ অনুযায়ী চার বর্ণসমূহ বলতে বোঝায় চার প্রকারের কর্মকান্ড যা পছন্দের উপর ভিত্তি করে, একই ব্যক্তি প্রকাশ করতে পারে চার বর্ণের বৈশিষ্ট্য চার ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে। এইভাবে সকলেই চার বর্ণের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সারল্যতার জন্য, আমরা বলি প্রধান পেশাকে বর্ণের পরিচয় হিসেবে। এবং এই কারণে সকল মানুষের উচিত পূর্ণভাবে চার বর্ণ হবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করা, যেমনভাবে বেদের জ্ঞান আমাদের বলে। এই হলো পুরুষ সুক্তের সারাংশ।

ঋষি বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র, অঙ্গীরা, গৌতম, বামদেব ও কন্ব - এরা সকলেই চার বর্ণের বৈশিষ্ট্যের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তারা বৈদিক মন্ত্রের অর্থ উদ্ভাবন করেছেন, দস্যু দমন করেছেন, দৈহিক শ্রমের কর্ম করেছেন এবং নিজেদেরকে যুক্ত করেছেন সমাজ কল্যাণের জন্য সম্পদ ব্যবস্থাপনায়।
আমাদেরও উচিত এমনটিই হওয়া।

অবশেষে আমরা দেখলাম বৈদিক সমাজ সকল মানুষকে একই জাতি বা গোষ্ঠী হিসেবে গণ্য করে, শ্রমের মর্যাদা বহাল রাখে, এবং সকল মানুষের জন্য সমান সুযোগ প্রদান করে যাতে তারা নিজ নিজ বর্ণ গ্রহণ করতে পারে।
বেদে কোনো প্রকার জন্মগত বৈষম্যের উল্লেখ নেই।
আমরা যেন সকলে একযুক্ত হয়ে একটি পরিবারের ন্যায় একতাবদ্ধ হতে পারি, প্রত্যাখান করতে পারি জন্মগত সকল বৈষম্যকে এবং একে অপরকে ভাই-বোন হিসেবে সদ্ব্যবহার করতে পারি।
আমরা যেন সকল পথভ্রষ্টকারীদের ভুল পথে এগুনো ব্যাহত করতে পারি যারা বেদে বর্ণভেদ সম্পর্কে ভিত্তিহীন দাবী করে এবং দমন করি সকল দস্যু, অসুর, রাক্ষসদের।
আমরা যেন সকলে আসতে পারি বেদের আশ্রয়ে এবং একত্রে কাজ করে মানবতার বন্ধনকে আরো দৃঢ় করতে পারি এক পরিবার হিসেবে।

সুতরাং বেদ অনুযায়ী কোনো বর্ণভেদ নেই।

সোমবার, ১৫ আগস্ট, ২০১১

আর. কে. নারায়ণ-এর গল্প ........বাবার সাহায্য

অনুবাদ: আনিকা শাহ

বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে সোয়ামি হঠাৎ বুঝতে পারলো যে দিনটি সোমবার। যদিও এক মুহূর্ত আগেও মনে হচ্ছিল যে শুক্রবারের শেষ প্রহরটি চলছিল কিন্তু ইতোমধ্যেই সোমবার এসে গিয়েছে। সে আশা করল যেন একটা ভূমিকম্প এসে স্কুলের দালানটাকে ধূলিস্মাৎ করে দেয়, কিন্তু অ্যালবার্ট মিশনারী স্কুলের সেই দৃঢ় দালানটি এই একই প্রার্থনা উপেক্ষা করে প্রায় একশ বছরেরও ওপর হলো দাঁড়িয়ে আছে।
নয়টা বাজলে সোয়ামীনাথন আর্তনাদ করে উঠল, “আমার মাথা ব্যাথা।” তার মা বললেন, দতুই একটা জাটকায় ( ঘোড়া-টানা দুই চাকাওয়ালা গাড়ি) করে চলে যাস না কেন?”
“রাস্তার ঐ মাথায় যেয়ে আমি মারা যাই আর কি? তুমি জান জাটকায় ঝাঁকি খেতে কেমন লাগে?”
“তোর কি আজকে কোনো জরুরি পড়া আছে?”
“জরুরি না ছাই! ভূগোলের শিক্ষক তো এক বছরের ওপর হয়ে গেল একই পড়া পড়াচ্ছেন। আর গণিতের ক্লাস আছে, তার মানে পুরো একটা পিরিয়ড ধরে টিচারের মার খেতে হবে।…জরুরি পড়া!”
এবং মা তখন উদার হয়ে সোয়ামিকে স্কুলে না যাবার পরামর্শ দিলেন।
সাড়ে নয়টায়, যখন সোয়ামির স্কুলের মাঠে চিৎকার করার কথা ছিল তখন সে তার মার ঘরের খাটের ওপর শুয়ে থাকল।
ওর বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‍‍“স্কুল নাই আজকে?”
“মাথা ব্যাথা।” সোয়ামি উত্তর দিল।
“বাজে কথা! কাপড় পড়ে স্কুলে যা।”
“মাথা ব্যাথা।”
“তো রবিবারে এখানে সেখানে একটু কম ঘোরাঘুরি করলেই সোমবার আর মাথাব্যাথা থাকে না।”
সোয়ামি জানত যে তার বাবা কতটা একগুঁয়ে তাই সে তার কৌশল পরিবর্তন করল। “তাই বলে আমি এত দেরিতে স্কুলে যেতে পারি না।”
“স্কুলে তো তোকে যেতেই হবে কারণ এটা তোর নিজেরই দোষ। না যাওয়ার কথা ভাবার আগে তুই আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারতি।”
“কিন্তু আমি এত দেরিতে গেলে টিচার কী ভাববে?”
“তাকে বলিস যে তোর মাথা ব্যথা ছিল তাই দেরি হয়েছে।”
“একথা বললে সে আমাকে ধরে মারবে।”
“তাই নাকি? দেখি, তার নাম কী?”
“স্যামুয়েল।”
“সে ছেলেদের মারে?”
“সে খুবই হিংস্র , বিশেষ করে দেরিতে আসা ছেলেদের প্রতি। কয়েকদিন আগে একটা ছেলে দেরিতে আসায় ওকে পুরো একটা পিরিয়ড নীলডাউন হয়ে থাকতে হয়েছিল, তারপর তাকে ছয়টা বেতের বাড়ি এবং কানমলা খেতে হয়েছিল। আমি স্যামুয়েলের ক্লাসে দেরিতে যেতে চাই না।”
rk-2.jpg…….
ছয় বছর বয়সে আর. কে. নারায়ণ, সাল ১৯১২।
…….
“সে যদি এতই হিংস্র হয়, তাহলে তোরা এ ব্যাপারে হেডমাস্টারকে কিছু বলিস না কেন?”
“সবাই বলে যে এমনকি হেডমাস্টারও স্যামুয়েলকে ভয় পায়। সে এতই হিংস্র।”
তারপর সোয়ামি স্যমুয়েলের হিংস্রতার একটি ভয়ংকর বর্ণনা দিল: কীভাবে সে একবার কাউকে বেতানো শুরু করলে তার হাতে রক্ত না দেখা পর্যন্ত থামত না; তারপর ছেলেটিকে সেই রক্ত সিঁদুরের ফোঁটার মত কপালে লাগাতে বাধ্য করত।
সোয়ামি আশা করল যে তার বাবা হয়ত বুঝবে যে সে দেরিতে স্কুলে যেতে পারবে না। কিন্তু তার বাবার ব্যবহারে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন আসল। তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। “এরা আমাদের ছেলেদের মেরে কী বোঝাতে চায়? এদের চাকরি থেকে বের করে দেওয়া উচিত। আমি দেখব…।”
ফলাফল এমন হল যে, তিনি সোয়ামিকে স্কুলে পাঠানোটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেন। তিনি সোয়ামির সাথে হেডমাস্টারের জন্য একটি চিঠি দিবেন বলেও ঠিক করলেন। সোয়ামির শত আপত্তি সত্বেও কোনো লাভ হলো না–তাকে স্কুলে যেতেই হল।
সোয়ামি স্কুলের জন্য তৈরি হতে হতে তার বাবা হেডমাস্টারের জন্য একটি চিঠি লিখে খামে ভরে সীল করে দিল।
“তুমি এখানে কী লিখেছো বাবা?” সোয়ামি শঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করল।
“তোর জন্য কিছু না। এটা হেডমাস্টারকে দিয়ে তারপর তুই ক্লাসে যাবি।”
“তুমি কি আমাদের শিক্ষক স্যামুয়েল সম্পর্কে কিছু লিখেছো?”
“তার সম্পর্কে অনেক কিছুই লিখেছি। তোর হেডমাস্টার যখন এটা পড়বেন তখন তিনি সম্ভবত স্যামুয়েলকে বরখাস্ত করবেন এবং পুলিশে দিয়ে দিবেন।”
“সে কী করেছে বাবা?”
“সে যা যা করেছে তার সমস্ত কিছুর বর্ণনা এখানে আছে। তুই তোর হেডমাস্টারকে এটা দিয়ে ক্লাসে যাবি। তার মতামত নিয়েই বিকেলে তুই বাড়ি ফিরবি।”
স্কুলে যেতে যেতে সোয়ামির মনে হল যে সে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মিথ্যাবাদী। তার নীতিবোধ তাকে পীড়িত করতে লাগল। সে জানত না যে স্যামুয়েল সম্পর্কে তার দেয়া সমস্ত বর্ণনা আদৌ সঠিক ছিল কিনা। তার বলা কথার কতটুকু বাস্তব এবং কতটুকু কল্পিত ছিল সে সম্বন্ধে সে নিশ্চিত হতে পারছিল না।
সে রাস্তার ধারে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়াল, স্যামুয়েল সম্পর্কে তার ধারণাগুলো স্থির করার জন্য। সে মানুষ হিসেবে ততটা খারাপও নয়। ব্যক্তি হিসেবে সে অন্যদের চেয়ে অমায়িক ছিল। মাঝে মাঝে সে সোয়ামির আলস্যকে কেন্দ্র করে দু’একবার ঠাট্টা করত এবং সোয়ামি সেটাকে তার প্রতি স্যামুয়েলের ব্যক্তিগত বিবেচনা হিসেবেই মনে করত। কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নেই যে স্যামুয়েল মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করত…তার বেত মানুষের হাতের চামড়া উঠিয়ে ফেলত।
সোয়ামি এসব ঘটনার উদাহরণ মনে করার চেষ্টা করল কিন্তু তার জানা এমন কোনো দৃষ্টান্ত ছিল না।
অনেক বছর আগে প্রথম শ্রেণীর একজন ছেলের আঙুলের গাটের চামড়া ছিলে ফেলার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনা কেউ দেখেনি, কিন্তু বছরের পর বছর গল্পটি ছাত্রদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল।
স্যমুয়েলের চরিত্র আসলে ভাল নাকি খারাপ, সে কি আসলেই চিঠিতে লেখা অভিযোগগুলোর যোগ্য কিনা–এই বিভ্রান্তিতে সোয়ামির মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগল। তার মনে হতে লাগল দৌড়ে বাসায় গিয়ে তার বাবাকে চিঠিটি ফিরিয়ে নেবার অনুরোধ করে। কিন্তু তার বাবা ছিল বড়ই একগুঁয়ে।
স্কুলের হলুদ দালানটার কাছে এসে তার মনে হলো সে নিজের সাথেই মিথ্যাচার করেছে এবং তার শিক্ষকের ক্ষতি করেছে। হেডমাস্টার সম্ভবত স্যামুয়েলকে বরখাস্ত করবেন এবং তারপর পুলিশ তাকে জেলে আটকে রাখবে। তার এই অসম্মান, অপমান ও দুর্দশার জন্য কে দায়ী থাকবে? সোয়ামি কেঁপে উঠল। যত বেশি সে স্যামুয়েলের কথা চিন্তা করতে লাগল ততই সে দুঃখ পেতে লাগল। তার কালো হয়ে যাওয়া চেহারা, ছোট হয়ে আসা লাল , ভাঁজ-পড়া চোখ, সূক্ষ্ম গোফের রেখা, না কামানো গাল ও চিবুক, হলুদ কোটÑ এসব চিন্তা সোয়ামিকে পীড়িত করে তুলল। যখনই সে তার পকেটের ভেতর খামটার অস্তিত্ব অনুভব করছিল, তার মনে হচ্ছিল যেন সে একজন জল্লাদ। এক মুহূর্তের জন্য সে নিজের বাবার ওপর রেগে উঠল এবং ভাবল, এমন যুক্তিবহির্ভূত এবং জেদী একজন মানুষের চিঠি সে কেন ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে না।
সে যখন স্কুলের গেটে ঢুকল, তার মাথায় একটা বুদ্ধি আসল; অনেকটা সমাধানের মত। সে এখনই হেডমাস্টারকে চিঠিটা দিবে না। বাবার অবাধ্য হয়ে এবং নিজের স্বাধীনতার চর্চা করে সে দিনের শেষে চিঠিটা দিবে। এতে অন্যায় কিছুই নেই এবং বাবাও কোনোভাবেই এটা জানতে পারবে না। তাছাড়া সে যদি দিনের শেষেই চিঠিটা দেয় তাহলে স্যামুয়েল এমন কিছু করতে পারে যাতে চিঠিটার সত্যতা প্রমাণিত করার সুযোগ আসে।
সোয়ামি ক্লাসের প্রবেশপথের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল। স্যামুয়েল তখন গণিত পড়াচ্ছিলেন। তিনি কিছুক্ষণ সোয়ামির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। সোয়ামির আশা ছিল স্যামুয়েল তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন এবং তার চামড়া ছিলে ফেলবেন। কিন্তু তিনি শুধুমাত্র জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি এইমাত্র ক্লাসে আসলে?”
“জ্বি, স্যার।”
“তুমি দেড় ঘণ্টা দেরিতে এসেছ।”
“আমি জানি।” সোয়ামি আশা করল তাকে এখনই আক্রমণ করা হবে। সে প্রায় প্রার্থনা করতে শুরু করল: তিরুপতি ভগবান, স্যামুয়েল যেন আমাকে মারে।
“এত দেরিতে এলে কেন?”
সোয়ামি উত্তর দিতে চাইল, “তুমি কী করো তা দেখার জন্য।” কিন্তু সে শুধু বলল, “আমার মাথাব্যাথা, স্যার।”
“তাহলে তুমি স্কুলে আসলেই বা কেন?”
স্যামুয়েলের কাছ থেকে একদমই অপ্রত্যাশিত একটা প্রশ্ন।
“আমার বাবা বললেন যে আমার ক্লাস বাদ দেয়া উচিত হবে না,” সোয়ামি বলল।
একথা স্যামুয়েলকে প্রভাবিত করল বলে মনে হল। “তোমার বাবার কথা একদম ঠিক। তিনি খুবই বিচক্ষণ ব্যক্তি। আমরা তার মত অভিভাবক আরও চাই।”
“আহা! বেচারা,” সোয়ামি ভাবল। “যদি তুমি জানতে আমার বাবা তোমার সাথে কী করেছে!”
সোয়ামি কখনও স্যামুয়েলের স্বভাব সম্পর্কে এত হতবুদ্ধি হয়নি।
“ঠিক আছে, তুমি তোমার সিটে যাও। এখনও কি তোমার মাথাব্যাথা আছে?”
“সামান্য আছে, স্যার।”
সোয়ামি দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে সিটে গেল। সে কখনও স্যামুয়েলের মত এমন ভাল মানুষ দেখেনি। তিনি বাড়ির কাজগুলো দেখছিলেন যা সাধারণত হিংস্রতায় পূর্ণ কিছু দৃশ্য উৎপন্ন করত (অন্তত সোয়ামির তাই ধারণা)। নোটবই মুখের ওপর ছুড়ে ফেলার কথা, ছেলেদের সাথে খারাপ ব্যবহার করার কথা, বেত মারা এবং বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখার কথা। কিন্তু আজ স্যামুয়েলকে দেখে মনে হল তার সহ্যশক্তি এবং ভদ্রতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। খারাপ খাতাগুলো সে দূরে ঠেলে দিল, ছেলেদের গায়ে বেতটা ছোঁয়ালো মাত্র এবং কাউকেই কয়েক মিনিটের বেশি দাঁড় করিয়ে রাখল না। সোয়ামির পালা এলো। সে এই সুযোগের জন্য ভগবানকে ধন্যবাদ জানালো।
“সোয়ামীনাথন, তোমার বাড়ির কাজ কোথায়?”
“আমি বাড়ির কাজ করিনি, স্যার,” সে নম্রভাবে জবাব দিল।
কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে স্যামুয়েল জিজ্ঞেস করলেন, “কেন, মাথাব্যাথা?”
“জ্বি স্যার।”
“ঠিক আছে, বসো।”
সোয়ামি বসল এবং ভাবতে লাগল স্যামুয়েলের হয়েছেটা কী। ক্লাস শেষ হয়ে গেল এবং সোয়ামি বড়ই নিরানন্দ বোধ করতে লাগল।
সেদিন শেষের ক্লাসটা আবার স্যামুয়েল নিলেন। ক্লাস ৩:৪৫ টায় শুরু হল এবং ৪:৩০ এ শেষ হবার কথা ছিল। তিনি এবার ‘ভারতীয় ইতিহাস’ পড়াতে এলেন।
এর আগের পিরিয়ডগুলোতে সোয়ামি গভীরভাবে চিন্তা করেছিল। কিন্তু স্যামুয়েলকে রাগানোর বা উত্তেজিত করার কোনো পরিকল্পনাই সে করে উঠতে পারছিল না। ঘড়িতে চারটা বাজতেই সোয়ামি মরিয়া হয়ে উঠল। আর মাত্র আধ ঘণ্টা। স্যামুয়েল একটা বই পড়ছিলেন যেখানে ভাস্কো-ডা-গামার ভারত আসার কথা বর্ণিত ছিল। ছাত্ররা প্রায় নির্জীব ভাবে শুনছিল। সোয়ামি উচ্চস্বরে বলল, “কলম্বাস কেন ভারতে আসেননি স্যার?”
“তিনি পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন।”
“আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, এটা অবিশ্বাস্য, স্যার।”
“কেন?”
“এত মহান মানুষ; তিনি কি রাস্তা জানতেন না?”
“চিৎকার করো না আমি তোমার কথা ভালোভাবেই শুনতে পাচ্ছি।”
“আমি চিৎকার করছি না, স্যার, এটা আমার স্বাভাবিক স্বর যা কিনা ঈশ্বরের দেওয়া। আমি এর কীইবা করতে পারি ?”
“তুমি চুপ করে বসো।”
সোয়ামীনাথন বসল। নিজের সাফল্যে সে খানিকটা খুশিই হল।
শিক্ষক খানিকটা ধাঁধা এবং সন্দেহ নিয়ে তার দিকে তাকালেন এবং পুনরায় পড়ানো শুরু করলেন।
এর পর সুযোগ আসল যখন প্রথম বেঞ্চে বসা শংকর জিজ্ঞেস করল, “স্যার, ভাস্কো-ডা-গামাই কি ভারতে আসা প্রথম মানুষ ছিলেন?”
শিক্ষক উত্তর দেওয়ার আগেই পেছনের বেঞ্চ থেকে সোয়ামি চিৎকার করে উঠল, “সবাই তো তাই বলে।”
টিচার এবং সব ছেলেরা তার দিকে তাকালো। সোয়ামির আজকের অবাঞ্ছিত ব্যবহারে স্যামুয়েল রীতিমতো হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলেন। “সোয়ামীনাথন, আবার চিৎকার করছ তুমি?”
boi.jpg…….
নারায়ণের প্রথম উপন্যাস সোয়ামি অ্যান্ড ফ্রেন্ডস
…….
“আমি চিৎকার করছি না, স্যার। ঈশ্বরের দেওয়া কণ্ঠের আমি কীইবা করতে পারি?” স্কুলের ঘড়ি বলল যে সোয়া এক ঘণ্টা শেষ। আর পনের মিনিট। সোয়ামির মনে হল যে এই পনের মিনিটে তার সাংঘাতিক কিছু একটা করতে হবে। স্যামুয়েল কয়েকবার ভ্রুকুটি করল এবং তিরস্কার করল কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না। সোয়ামির মনে হল যে আরেকটু চেষ্টা করলেই স্যামুয়েলকে বরখাস্ত ও কারারুদ্ধ করা যেতে পারে।
শিক্ষক বইয়ের একটা অংশ শেষ করে থামলেন। তিনি বললেন যে তিনি বাকি সময়টুকু ছেলেদের প্রশ্ন করবেন।
তিনি ক্লাসের সবাইকে বই সরিয়ে রাখার নির্দেশ দিলেন এবং দ্বিতীয় সারিতে বসা কাউকে জিজ্ঞেস করলেন, “ভাস্কো-ডা-গামার ইন্ডিয়ায় আসার তারিখ কত?”
সোয়ামি হঠাৎ কর্কশ স্বরে বলল, “১৬৪৮, ডিসেম্বর ২০।”
“তোমার চেঁচানোর দরকার নেই,” শিক্ষক বললেন।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার মাথাব্যাথা কি তোমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে?”
“আমার এখন মাথাব্যাথা নেই, স্যার”, সে বজ্রধ্বনির মত উচ্চকণ্ঠে উত্তর দিল।
“বসো, মূর্খ কোথাকার।” সোয়ামিকে মূর্খ বলায় সে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল।
“আরেকবার যদি তুমি উঠে দাঁড়াও তাহলে আমি তোমাকে বেত দিয়ে মারব,” শিক্ষক বললেন। সোয়ামি এই প্রতিশ্রুতির কথা শুনে আনন্দের সাথে বসল।
শিক্ষক তখন বললেন, “আমি মুঘল পর্যায় সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করব। মুঘল রাজাদের মধ্যে কাকে তোমরা সবচেয়ে মহান, কাকে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং কাকে সবচেয়ে ধর্মপরায়ণ বলবে?”
সোয়ামি উঠে দাঁড়ালো। ওকে দেখা মাত্রই শিক্ষক জোর দিয়ে বললেন, “বসো।”
“আমি উত্তর দিতে চাই, স্যার।”
“বসো।”
“না, স্যার, আমি উত্তর দিতে চাই।”
“তুমি আবার উঠে দাঁড়ালে আমি কী করব বলেছিলাম?”
“আপনি বলেছিলেন যে আপনি আমাকে বেত দিয়ে মারবেন এবং আমার আঙুলের চামড়া উঠিয়ে ফেলবেন এবং সেটা আমার কপালে লাগাতে বাধ্য করবেন।”
“ঠিক আছে, এদিকে আসো।”
সোয়ামীনাথন আনন্দের সাথে সিট ছেড়ে উঠল এবং রীতিমতো লাফ দিয়ে সামনে গেল। শিক্ষক ড্রয়ার থেকে বেত বের করে রাগান্বিত স্বরে চিৎকার করলেন, “হাত পাতো, শয়তান কোথাকার!”
প্রতিটি হাতে তিনি তিনটা করে বাড়ি দিলেন। সোয়ামি সংকুচিত না হয়েই সেগুলো গ্রহণ করল।
অর্ধডজন বাড়ি দেবার পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “এগুলো কি যথেষ্ট নাকি তুমি আরো চাও?” সোয়ামি আবার হাত বাড়িয়ে দিয়ে আরো দুটো বাড়ি খেল; এমন সময় ঘণ্টা বাজল।
let-2.jpg
১৯৩৫ সালে আর. কে. নারায়ণকে তাঁর উপন্যাসের জন্য প্রকাশক পাওয়ার কথা জানাচ্ছেন গ্রাহাম গ্রিন।
সোয়ামি হালকা মন নিয়ে সেখান থেকে লাফিয়ে নামল, যদিও তার হাতে সে হুল ফোটার মত ব্যথা অনুভব করছিল। সে নিজের বইগুলো নিল, পকেট থেকে চিঠিটা বের করল এবং হেডমাস্টারের রুমের দিকে দৌড় দিল। সে পিওনকে জিজ্ঞেস করল, “হেডমাস্টার কোথায়?”
“তাকে তোমার কী দরকার?”
“আমার বাবা তার জন্য একটা চিঠি দিয়েছেন।”
“তিনি তো আজ দুপুরবেলাই ছুটি নিয়েছেন, আর দুই সপ্তাহের মধ্যে আসবেন না। তুমি অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টারকে চিঠিটা দিতে পার।”
“তিনি কে?”
“তোমাদের শিক্ষক স্যামুয়েল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তিনি চলে আসবেন।”
“সোয়ামীনাথন সেখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে গেল। চিঠিসহ সে যখন বাড়ি পৌঁছলো, তার বাবা মন্তব্য করলেন, “আমি জানতাম তুই চিঠিটা দিতে পারবি না, ভীরু কোথাকার।”
“আমি দিব্যি দিচ্ছি, আমাদের হেডমাস্টার ছুটিতে…”, সোয়ামি শুরু করল।
বাবা বললেন, “তোর ভীরুতাকে ঢাকার জন্য মিথ্যা কথা বলার দরকার নেই।”
সোয়ামি খামটা দেখিয়ে বলল, “হেডমাস্টার ফিরে আসার সাথে সাথেই আমি এটা তাকে দিব।”
বাব তার হাত থেকে চিঠিটা কেড়ে নিয়ে ছিড়ে ফেললেন এবং টেবিলের নিচে রাখা ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিলেন। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, “এরপর স্যামুয়েল তোর টুঁটি চেপে ধরলেও আমার কাছে আসিস না। তুই তোর স্যামুয়েলেরই যোগ্য।”


সূত্র- arts.bdnews24.com

আর. কে. নারায়ণ-এর গল্প ...... মাসে পঁয়তাল্লিশ টাকা

অনুবাদ: আনিকা শাহ

শান্তা আর ক্লাসে থাকতে পারছিল না। কাদার ছাঁচ বানানো, গান, ড্রিল, অক্ষর আর সংখ্যা পরিচয় সব ক্লাস শেষ করে ও রঙ্গিন কাগজ কাটছিল। ঘন্টা বাজার পর যতক্ষণ না টিচার বলেন, “এখন তোমরা বাড়ি যেতে পার” অথবা, “কাঁচি সরিয়ে রেখে অক্ষরগুলো তুলে নাও” ততক্ষণ পর্যন্ত ওকে কাগজ কাটতে হবে। শান্তা সময় জানার জন্য অস্থির হয়ে উঠছিল। ও ওর পাশে বসা বন্ধুকে জিজ্ঞেস করল, “এখন কি পাঁচটা বাজে?”
“হয়তো”, সে উত্তর দিল।
“নাকি এখন ছয়টা বাজে?”
“মনে হয়না” ওর বন্ধু উত্তর দিল, “কারণ ছয়টার সময়ে রাত হয়ে যায়।”
“তোর কি মনে হয় এখন পাঁচটা বাজে?”
“হ্যা।”
“ওহ, আমাকে যেতে হবে। বাবা এতক্ষণে বাসায় এসে যাবে। বাবা বলেছিল আমাকে পাঁচটার মধ্যে তৈরি হয়ে থাকতে। বাবা আজকে সন্ধ্যায় আমাকে সিনেমায় নিয়ে যাবে। আমাকে বাসায় যেতেই হবে।”
কাঁচিটা ফেলে রেখে ও টিচারের কাছে দৌঁড় দিলো। “ম্যাডাম, আমাকে বাসায় যেতে হবে।”
“কেন, শান্তা বাঈ?”
“কারণ এখন পাঁচটা বাজে।”
“তোমাকে কে বলল যে এখন পাঁচটা বাজে?”
“কমলা।”
“এখন পাঁচটা বাজেনা। এখন- তুমি ঐখানের ঘড়িটা দেখতে পাচ্ছ? আমাকে বল তো এখন সময় কত? আমি সেদিন তোমাকে ঘড়ি দেখতে শিখিয়েছিলাম।”
শান্তা একেদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে সংখ্যাগুলো সতর্কভাবে গুনে ঘোষণা করল,“এখন নয়টা বাজে।”
টিচার অন্যান্য মেয়েদের ডেকে জিজ্ঞেস করলেন,কে আমাকে ঘড়ির সময়টা বলবে?” ওদের অনেকেই শান্তার সাথে একমত হয়ে বলল যে আসলেই নয়টা বাজে যতক্ষণ না টিচার বললেন,তোমরা শুধু বড় কাটাটা দেখছ। ছোট কাটাটা দেখো, কোথায় ওটা?”
“দুই আর অর্ধেকে।”
“তাহলে কয়টা বাজে?”
“দুইটা আর আরও অর্ধেকটা বাজে।”
“এখন দুইটা পঁয়তাল্লিশ বাজে, বুঝলে? এখন তোমরা সবাই সিটে যাও।” দশ মিনিটের মাথায় শান্তা আবার টিচারের কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করল,“এখন কি পাঁচটা বাজে, ম্যাডাম, কারণ পাঁচটার মধ্যে আমাকে তৈরি হয়ে থাকতে হবে। নাহলে বাবা আমার ওপর রাগ করবে। বাবা আমাকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে বলেছে।”
“কখন?”
“এখন।”
টিচার শান্তাকে যাবার অনুমতি দিলে ও বইখাতা নিয়ে আনন্দে চিৎকার করে ঝড়ের বেগে ক্লাস থেকে বের হয়ে এলো।ও ছুটে বাসায় এসে বইগুলো মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে ডাকল, “মা, মা।”
মা পাশের বাসায় তার বান্ধবীর সাথে গল্প করতে গিয়েছিলেন। তিনি সেখান থেকে দৌঁড়ে চলে আসলেন।“তুমি এত তাড়াতাড়ি ফিরলে কেন?” মা জানতে চাইলেন।
“বাবা কি বাসায় এসে গিয়েছে?” শান্তা জিজ্ঞেস করল। কফি কিংবা টিফিন না খেয়ে আগে সে তেরি হতে বসল। ট্রাঙ্ক খুলে ও ওর সবচেয়ে পাতলা ফ্রক আর নিকারটা পড়তে চাইল কিন্তু মা চাইলেন সন্ধ্যার জন্য ওকে লম্বা স্কার্ট আর মোটা কোটটা পরাতে। শান্তা যে কার্ডবোর্ডের সাবানের বাক্সটায় পেন্সিল, ফিতা আর চকের টুকরা রাখে, সেখান থেকে চমৎকার একটা ফিতা বেছে নিলো। জামা নিয়ে মা আর মেয়ের মধ্যে বেশ উত্তপ্ত বাক্-বিতন্ডা হল এবং শেষ পর্যন্ত মাকে হাল ছাড়তেই হল। শান্তা ওর প্রিয় গোলাপি জামাটা পড়ল আর চুলে বেনী করে তাতে একটা ফিতা বাঁধল। তারপর মুখে পাউডার দিয়ে আর কপালে সিঁদুরের টিপ দিয়ে ও বলল, “এখন বাবা বলবে আমি খুব ভাল মেয়ে কারণ আমি তৈরি হয়ে গিয়েছি। তুমি যাচ্ছ না, মা?”
আজকে নয়।”
***
শান্তা ছোট্ট গেটটাতে দঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকাল।
মা বললেন, “বাবা তো পাঁচটার পরে আসবে। রোদে দাঁড়িয়ে থেকো না। এখন কেবল চারটা বাজে।”
উল্টো দিকের বাড়িগুলোর পেছনে সূর্য যখন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল তখন শান্তা বুঝতে পারল অন্ধকার হয়ে যাবে। ও দৌঁড়ে মার কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করল, মা, বাবা কেন এখনও আসছে না?”
আমি কি করে জানব? মনে হয় অফিসের কাজে আটকে গেছে।”
শান্তা মুখ বাঁকালো, “অফিসের লোকগুলোকে আমার ভাল লাগেনা। ওরা খারাপ লোক…।”
ও আবার গেটের কাছে গিয়ে বাইরে তাকাল। মা ভেতর থেকে ডাকলেন, ভেতরে আস শান্তা, অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। ওখানে দাঁড়িয়ে থেকো না।” কিন্তু শান্তা ভেতরে গেলো না। ও গেটে দাঁড়িয়ে থাকল আর তখনই ওর মাথায় অদ্ভুত একটা বুদ্ধি আসল। ও কেন অফিসে যেয়ে বাবাকে নিয়ে তারপর সিনেমায় যায় না? ও চিন্তা করল বাবার অফিস কোথায় হতে পারে। ওর এ সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না।ও প্রতিদিন দেখে বাবা রাস্তার শেষ মাথায় যেয়ে বাঁক ঘোরে। কেউ যদি ওখানে যায়, সে মনে হয় আপনা আপনি বাবার অফিসে পৌঁছে যাবে।ও একবার তাকিয়ে দেখল মা আশেপাশে আছে কিনা, তারপর রাস্তায় নেমে গেল।
***
তখন ছিল গোধূলি। যারা রাস্তায় যাচ্ছিল তাদের সবাইকে বিশাল দেখাচ্ছিল, ঘরের দেয়ালগুলোকে মনে হচ্ছিল অনেক উঁচু আর সাইকেল আর গাড়িগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন সব ওর ওপর এসে পড়বে।
ও রাস্তার প্রায় শেষ মাথায় এসে পড়ল। কিছুক্ষণ পরই রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে উঠলো আর পথিকদের ছায়ার মত দেখাতে লাগল। দুবার বাঁক ঘোরার পর শান্তা আর বুঝতে পারলছিল না ও কোথায় ছিল।ও নখ কাঁমড়াতে কাঁমড়াতে রাস্তার শেষ মাথায় এসে বসে পড়ল। ও তখন ভাবছিল কি করে ঘরে ফেরা যায়। ওদের পাশের বাড়ির ভৃত্যটি তখন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাকে দেখে শান্তা উঠে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
ওহ, তুমি একা একা এখানে কি করছ?” তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
শান্তা জবাব দিল, আমি জানি না। আমি এখানে চলে এসেছি। তুমি কি আমাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে?” এরপর তার পেছন পেছন শান্তা জলদিই বাড়ি পৌঁছে গেল।
***
শান্তার বাবা ভেঙ্কাত রাও সেদিন সকালে অফিসের জন্য রওনা দিতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় একটা জাটকা সিনেমার বিজ্ঞাপন ছড়াতে ছড়াতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। শান্তা দৌঁড়ে রাস্তায় এসে একটা বিজ্ঞাপন উঠিয়ে নিয়ে তুলে ধরে জিজ্ঞেস করেছিল,বাবা, তুমি আজকে আমাকে সিনেমায় নিয়ে যাবে?”প্রশ্নটা শুনে ভেঙ্কাত রাওয়ের মনটা খুব খারাপ হয়েছিল। বাচ্চাটা কোন ধরনের আমোদ-প্রমোদ আর জীবনের সাধারণ আনন্দগুলো ছাড়াই বেড়ে উঠছে। তিনি ওকে দুবারও সিনেমায় নিয়ে গিয়েছেন কিনা সন্দেহ । বাচ্চাটাকে তিনি একদম সময় দিতে পারেন না। যেখানে ওর বয়সী অন্যান্য বাচ্চারা পুতুল, জামাকাপড় কিংবা বেড়াতে যাবার সুযোগ সবই পেয়ে যায়, সেখানে শান্তা যেন একদম একা একা, রূঢ়ভাবে বেড়ে উঠছিল।
তিনি তখন তার অফিসের ওপর প্রচন্ড রেগে গিয়েছিলেন। মাসে চল্লিশটা টাকা দিয়ে মনে হয় যেন ওরা তাকে পুরোদস্তুর কিনে ফেলেছে।
***
স্ত্রী-কন্যাকে অবহেলা করার জন্য তিনি নিজেকে ভর্ৎসনা করেছিলেন। এমনকি তার স্ত্রীরও নিজের বন্ধু-বান্ধবের দল থাকতে পারত, আরও অনেক কিছুই থাকতে পারত। সে তো তাও বয়স্ক, কিন্তু শান্তা? কি নীরস, একঘেয়ে ওর জীবনটা! প্রতিটা দিন ওরা তাকে সন্ধ্যা সাতটা-আটটা পর্যন্ত অফিসে আটকে রাখে আর বাসায় ফিরে দেখা যায় শান্তা ঘুমিয়ে পড়েছে। এমনকি রোববারেও ওরা চায় যে সে অফিসে থাকুক। কেন ওরা ভাবে তার কোন ব্যক্তিগত জীবন নেই, নিজের কোন জীবন নেই? বাচ্চাটাকে পার্কে কি সিনেমায় নিয়ে যাবেন, সে সময়টা পর্যন্ত ওরা তাকে দেয়না।তিনি তখন ওদের দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন যে তিনি তাদের খেলার বস্তু না। হ্যা, প্রয়োজনে তিনি তার ম্যানেজারের সাথে ঝগড়া করার জন্যও প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন।
তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বললেন, “আজ বিকেলে আমি তোমাকে সিনেমায় নিয়ে যাব। পাঁচটায় তৈরি হয়ে থেকো।”
“সত্যি! মা!”, শান্তা চিৎকার করে উঠলো। মা রান্নাঘর থেকে দৌঁড়ে আসলেন।
“বাবা আজ বিকেলে আমাকে সিনেমায় নিয়ে যাচ্ছে।”
শান্তার মা একথা শুনে ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন। বাচ্চার কাছে মিথ্যে প্রতিজ্ঞা করোনা…।” ভেঙ্কাত রাও তার দিকে তাকালেন, “বাজে কথা বলোনা। তুমি তো ভাবো একমাত্র তুমিই কথা দিয়ে কথা রাখতে জানো।
তিনি শান্তাকে বললেন, “পাঁচটায় তৈরি থেকো আর আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাবো। যদি তুমি তৈরি হয়ে না থাক তাহলে কিন্তু আমি খুব রাগ করব।”
***
তিনি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়ে অফিসে গেলেন। তিনি তার নিয়মিত কাজগুলো করে পাঁচটায় বের হয়ে যাবেন। আর যদি ওরা ওদের পুরানো কৌশলগুলো খাটানোর চেষ্টা করে, তাহলে তিনি বসকে বলবেন, “এই আমার পদত্যাগপত্র। আমার কাছে আমার বাচ্চার আনন্দ আপনার ঐ বাজে কাগজগুলোর চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।”
সারাদিনই কাগজপত্রগুলো স্রোতের মত তার টেবিলে আসতে থাকল, যেতে থাকল। তিনি সেগুলো পরীক্ষা করলেন, বাছাই করলেন, সাক্ষর করলেন। তাকে বারবার নিজেকে সংশোধন করতে বলা হল, সতর্ক ও অপমান করা হল। তিনি দুপুরে কফির জন্য মাত্র পাঁচ মিনিটের বিরতি পেলেন।
অফিসের ঘড়িতে যখন পাঁচটা বাজল আর অন্যান্য ক্লার্করা চলে যাচ্ছিলেন, তখন ভেঙ্কাত রাও ম্যানেজারের কাছে গিয়ে বললেন, “আমি কি যেতে পারি, স্যার?”
ম্যানেজার তার সামনের কাগজ থেকে মুখ তুলে অবাক হয়ে বললেন, “তুমি!” এটা তো চিন্তাও করা যায় না যে ক্যাশ আর অ্যাকাউন্ট সেকশন পাঁচটায় বন্ধ হয়ে যাবে। তুমি কিভাবে যেতে পারো?”
“আমার কিছু জরুরি ব্যক্তিগত কাজ আছে, স্যার।” ভেঙ্কাত রাও বললেন আর সকাল থেকে আওড়াতে থাকা কথাগুলো ভাবতে থাকলেন: এই যে আমার পদত্যাগপত্র…।” তিনি যেন দেখতে পেলেন শান্তা তৈরি হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, ব্যাগ্রভাবে অপেক্ষা করছে।
অফিসের কাজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু থাকতে পারেনা। তুমি তোমার জায়গায় যাও। তুমি জানো আমি কতক্ষণ কাজ করি?” ম্যানেজার জানতে চাইলেন। ম্যানেজার অফিস শুরু হবার প্রায় তিন ঘণ্টা আগে আসতেন আর অফিস শেষ হবার প্রায় তিন ঘণ্টা পর পর্যন্ত থাকতেন, এমনকি রোববারেও। অফিসের ক্লার্করা বলাবলি করত, ওর বউ মনে হয় বাসায় ওকে দেখলেই চাবকাতে থাকে; তাই বুড়ো প্যাঁচাটা অফিসে থাকতে এত ভালবাসে।”
“তুমি কি সেই গরমিলের কারণটা খুঁজে বের করেছো?” ম্যানেজারের প্রশ্ন।
এজন্য আমাকে ২০০টা ভাউচার পরীক্ষা করতে হবে। আমি ভাবছিলাম সেটা কালকে করব।”
“না, না, তা চলবে না। তোমাকে এখনই ভুলটা সংশোধন করতে হবে।”
ভেঙ্কাত রাও মিনমিন করে বললেন, “জ্বি, স্যার” এবং চোরের মত নিজের সিটে যেয়ে বসে পড়লেন।
***
ঘড়িতে ৫:৩০ বাজল। মানে আরও দু’ ঘণ্টা ধরে ভাউচার পরীক্ষা করার মত কষ্টকর কাজটা করতে হবে।অফিসের বাকি সবাই চলে গিয়েছে। শুধু তিনি আর তার সেকশনের আরেকজন ক্লার্ক তখনও কাজ করছিলেন, এবং অবশ্যই ম্যানেজার তো ছিলেনই। ভেঙ্কাত রাও খুব রেগে গেলেন। তিনি মনস্থির করে ফেললেন। তিনি এমন কোন দাস নন যে কিনা নিজেকে মাত্র ৪০ টাকায় বিকিয়ে দিয়েছে। তিনি সহজেই ঔ পরিমাণ টাকা আয় করতে পারেন। আর যদি নাও পারেন, তবুও ক্ষুধার তাড়নে মারা যাওয়াটা বোধহয় বেশি সম্মানজনক।
তিনি একটা কাগজ নিয়ে লিখতে শুরু করলেন: এই আমার পদত্যাগপত্র। আপনারা যদি ভেবে থাকেন যে শুধুমাত্র ৪০ টাকা দিয়ে আপনারা আমার দেহ ও আত্মা কিনে নিয়েছেন তবে আপনারা ভুল ভাবছেন। আমার মনে হয় না খেয়ে মারা যাওয়া আমার ও আমার পরিবারের জন্য সেই তুচ্ছ ৪০ টাকার দাসত্ব করার চেয়ে বেশি ভাল হবে, যে টাকার জোরে আপনি বছরের পর বছর আমাকে বেঁধে রেখেছেন। আমার ধারণা আমার বেতন বাড়িয়ে দেওয়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহও আপনাদের নেই। আপনারা নিজেদের জন্য প্রায়ই অনেক কিছু করেন, কিন্তু আমি বুঝিনা কেন আপনারা কালেভদ্রেও আমাদের কথা চিন্তা করেন না। তবে এখন আমার জানার কোনো ইচ্ছাও নেই, যেহেতু আমি পদত্যাগ করছি। আমি যদি সপরিবারে ক্ষুধার জ্বালায় নিঃশেষ হয়ে যাই, তবে প্রার্থনা করি যেন আমাদের অতৃপ্ত আত্মা আপনাদের আজীবন তাড়া করে…।” তিনি চিঠিটা ভাঁজ করে খামে পুরলেন, খামের মুখ আঁঠা দিয়ে আটকালেন, তারপর খামের ওপর ম্যানেজারের নাম লিখে দিলেন। তিনি সিট থেকে উঠে ম্যানেজারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ম্যানেজার হাতে হাতে চিঠিটা পেয়ে গেলেন এবং তার লেখার প্যাডের ওপর রাখলেন।
“ভেঙ্কাত রাও”, ম্যানেজার বললেন, “আমার মনে হয় তুমি এই খবরটা শুনে খুশি হবে। আমাদের অফিসাররা আজ বেতন বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছিলেন। আমি তোমার নাম সুপারিশ করেছি এবং তোমার বেতন পাঁচ টাকা বাড়ানোর কথা বলেছি। অর্ডার এখনও পাস হয়নি তাই, আমার মনে হয়, খবরটা আপাতত তোমার নিজের কাছে রাখাটাই ভাল হবে।” ভেঙ্কাত রাও লেখার প্যাডের মাঝে রাখা চিঠিটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি পকেটে ঢুকিয়ে ফেললেন।
“ওটা কিসের চিঠি ছিল?”
“আমি আসলে একটা সাময়িক ছুঠির জন্য আবেদন করেছিলাম, স্যার, কিন্তু আমার মনে হয়…।”
“তুমি তো আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে কোনো ছুটি নিতে পারবে না।”
“জ্বি, স্যার, আমি বুঝতে পেরেছি। এজন্যই আমি আমার দরখাস্ত ফেরত নিচ্ছি।”
“খুব ভালো। তা, তুমি ভুলটা খুঁজে বের করেছো?”
“আমি এখনও খুঁজছি, স্যার। এক ঘণ্টার মধ্যে বোধহয় সেটা বের হয়ে যাবে…।”
***
ভেঙ্কাত রাও বাসায় ফিরতে ফিরতে নয়টা বেজে গেল। শান্তা ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওর মা বললেন, “ও জামাটা পর্যন্ত বদলাতে চায়নি, এই ভেবে যে যেকোনো সময় তুমি আসবে আর ওকে বাইরে নিয়ে যাবে। ও কিছুই খায়নি। জামা কুঁচকে যাবে সেই ভয়ে শুতেও চায়নি…।”
***
ভেঙ্কাত রাওয়ের মনটা খুব খারাপ হল যখন তিনি দেখলেন শান্তা ঘুমাচ্ছে, তার গোলাপী জামা পরে, চুল বেঁধে, পাউডার দিয়ে… একদম বাইরে যাবার জন্য তৈরি হয়ে।
“ওকে আমি নাইট শো তে নিয়ে যাই না কেন?”
তিনি শান্তাকে আলতো করে ঝাঁকি দিয়ে ডাকলেন, “শান্তা, শান্তা”, শান্তা ঘুমের ঘোরে বিরক্ত হয়ে পা ছুঁড়ে কেঁদে উঠলো। মা “ওকে আর জাগিও না” বলে শান্তাকে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। ভেঙ্কাত রাও কিছুক্ষণ শান্তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর দুঃখিত গলায় বললেন, আমার পক্ষে ওকে আর বাইরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। আসলে, ওরা আমার বেতনটা বাড়িয়ে দিচ্ছে কিনা।”



সূত্র:- arts.bdnews24.com

আর. কে. নারায়ণ-এর গল্প....... ঈশ্বরণ

ভারতীয় ঔপন্যাসিক রসিপুরম কৃষ্ণসোয়ামি আয়ার নারায়ণস্বামী-এর জন্ম ১৯০৬ সালে মাদ্রাজে (বর্তমানে চেন্নাই)। নারায়ণ ইংরেজিতে লেখালেখি করেছেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস Swami and Friends বেরিয়েছিল ১৯৩৫ সালে। ঔপন্যাসিক গ্রাহাম গ্রিন এটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন। গ্রাহাম গ্রিনের পরামর্শে তিনি নাম সংক্ষিপ্ত করে আর. কে. নারায়ণও করেছিলেন। তাঁর উপন্যাস The Financial Expert মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। আর. কে. নারায়ণের ১৫টি উপন্যাসের ১৪টিরই পটভূমি কাল্পনিক শহর মালগুডি। নিখুঁত সৌন্দর্যমণ্ডিত, বুদ্ধিদীপ্ত, জীবনঘনিষ্ঠ ও উপলব্ধিজাত তাঁর লেখার বর্ণনা প্রায়শই দক্ষিণ ভারতের গ্রামজীবন ছুঁয়ে যায়। ২০০১ সালে মারা যান আর. কে. নারায়ণ। আর. কে. নারায়ণকে আমেরিকান ঔপন্যাসিক উইলিয়াম ফকনারের সঙ্গে তুলনা করা হয়। মানবিকতায় ঋদ্ধ তাঁর লেখালেখিতে প্রাত্যহিক জীবনের আনন্দ ও প্রাণশক্তি টের পাওয়া যায়।
cartoon-r-k.jpg
…….
(বড়ভাই) ইন্ডিয়ার জনপ্রিয় কার্টুনিস্ট আর. কে. লক্ষণের কার্টুনে লেখক আর. কে. নারায়ণ
……
আর. কে. নারায়ণের প্রবাদপ্রতীম গ্রহণযোগ্যতা সত্ত্বেও কিছু সমালোচনা হয়েছে। তিনি মারা যাওয়ার কিছুদিন পর ভারতেরদি হিন্দু পত্রিকায় লেখক ও সমালোচক শশি থারুর ‘Comedies of Suffering’ লেখায় এভাবে বলেছিলেন, “Narayan was a consummate teller of timeless tales, a meticulous recorder of the ironies of human life, an acute observer of the possibilities of the ordinary: India’s answer to Jane Austen… …But I felt that they also pointed to the banality of Narayan’s concerns, the narrowness of his vision, the predictability of his prose, and the shallowness of the pool of experience and vocabulary from which he drew.”

অনুবাদ: আনিকা শাহ

জুনের এক বিকেলে, যখন মালগুড়ির তাবৎ ছাত্রসমাজের মনে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার রেজাল্ট পাবার উত্তেজনা আলোড়ন তুলছিল, সেই সময়ে ঈশ্বরণ নির্বিকার এবং নির্লিপ্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
ঈশ্বরণ ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসের সবার মধ্যে বয়োজেষ্ঠ্য হবার খ্যাতি অর্জন করেছিল। সে অ্যালবার্ট মিশন স্কুলে এসেছিল ঠোঁটের উপর অস্পষ্ট গোঁফের রেখা নিয়ে, একজন তেজী তরুণ হিসেবে। এখনও অবশ্য তাকে সেখানেই দেখা যাচ্ছিল। শুধু তার গঠন হয়ে উঠেছিল আরও বলিষ্ঠ ও পেশিবহুল এবং চিবুকও তামাটে আর দৃঢ় দেখাচ্ছিল। কেউ কেউ এমনকি এ কথাও বলে যে ঈশ্বরণের মাথায় নাকি সাদা চুল দেখা যায়। প্রথমবার সে যখন ফেল করল তখন তার পরিবারের সবাই তাকে সমবেদনা জানালো। দ্বিতীয়বারও সে তাদের সমবেদনা আদায় করে নিতে সক্ষম হল। কিন্তু ধীরে ধীরে তারাও ছিদ্রান্বেষী আর নাছোড় হয়ে উঠল এবং এক সময় ঈশ্বরণের উপর্যুপরি অকৃতকার্যতায় তার পরীক্ষার উপর থেকে সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। ওর বাবা-মা ওকে প্রায়ই বলতেন, “তুই লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে কাজের কাজ কিছু করতে পারিস না?” আর ঈশ্বরণও প্রতিবার মিনতি করে বলত, “আমাকে এই শেষবারের মত চেষ্টা করতে দাও।” সে গভীর অনুরাগ নিয়ে নাছোড়বান্দার মত বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার পেছনে লেগে থাকত।
আর এখন পুরো শহর উত্তেজিত রেজাল্টের প্রতীক্ষায়। ছেলেরা দল বেঁধে রাস্তায় ঘুরতে লাগল; সরযুর তীরে ঝাঁক বেঁধে বসে ঘাবড়ে-যাওয়া হাসি হাসতে হাসতে নখ কাঁমড়াতে লাগল। অন্যরা সিনেট হাউসের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্নভাবে সেটার দেয়ালের দিকে–যার পেছনে কোনো মিটিং চলছিল–তাকিয়ে থাকল।
ছেলেদের চেয়ে বেশি না হলেও, বাবা-মায়েদের উত্তেজনা ছিল ছেলেদের মতই। অবশ্য ঈশ্বরণের বাবা- মা ছাড়া। তারা প্রতিবেশীদের মুখে তাদের ছেলের ভবিষ্যৎ ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মন্তব্য করলেন, “ঈশ্বরণের জন্য তো আর চিন্তা করার কিছু নাই। ওর ফলাফল তো বিখ্যাত আর সবারই আগাম জানা আছে।” ঈশ্বরণও ইয়ার্কি করে বলল, “আমি হয়ত এবার পাশ করেছি, বাবা। কে জানে! এইবার তো আমি বেশ ভালভাবেই পড়েছিলাম।” “এই মুহূর্তে গোটা ইন্ডিয়ার সবচেয়ে আশাবাদী মানুষটা তুই ই। এই একগুঁয়ে আশাটা না থাকলে নিশ্চয়ই তুই ফি বছর একই পরীক্ষা দিতি না।” “আমি তো গত বছর কেবল লজিকে ফেল করেছি, তাও অল্পের জন্য”, সে নিজের সাফাই গাইল। একথায় তার পুরো পরিবার হেসে উঠল। “যাই হোক, তুই বাইরে গিয়ে অন্য ছেলেদের সাথে রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করছিস না কেন?” ওর মা জিজ্ঞেস করলেন। “কোনো দরকার নাই” ঈশ্বরণ বলল, “আমি যদি পাশ করি তাহলে সেই খবর ওরা ঘরেই নিয়ে আসবে। তোমার কি মনে হয়, আমি গত বছর আমার রেজাল্ট দেখেছিলাম? আমি সময় কাটাচ্ছিলাম একটা সিনেমায় বসে। পর পর দুইটা শো দেখেছিলাম আমি।”
বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হবার আগে সে গুন গুন করতে করতে হাত-মুখ ধোয়ার জন্য ভেতরে গেল। সে খুব যত্ন নিয়ে চুল আঁচড়াতে লাগল, কারণ সে জানত যে বারবার ফেল করার জন্য সবাই তাকে অনেকটা ব্রাত্য হিসেবেই গণ্য করে। সে জানত যে তার পিঠপিছে তার পুরো পরিবার এবং পুরো শহর তাকে উপহাস করছিল। তার মনে হল যেন সবাই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল যে এই হাত-মুখ ধোয়া, চুল আঁচড়ানো কিংবা ইস্ত্রি করা জামা গায়ে দেয়া–এগুলো তার অবস্থার তুলনায় একটু বেশিই বিলাসবহুল। সে ব্যর্থ এবং এই বিলাসিতা উপভোগের কোনো অধিকার তার নেই। তার সাথে সবাই এমনভাবে ব্যবহার করত যেন সে কোনো মোটা চামড়ার গাধা। সে কখনও এসব পাত্তা দিত না। বরং তাদের ব্যবহারের জবাবে এমনভাবে আচরণ করত যেন সেও একজন খুব হিংস্র দুর্বৃত্ত। কিন্তু এসব ছিল কেবলই মুখোশ। এর পেছনে ছিল এমন এক প্রাণী যে ব্যর্থতার ঘায়ে পুরোপুরি বিপর্যস্ত ছিল। যেদিন রেজাল্ট দেবার কথা, সেদিন ভেতরে ভেতরে সে উৎকণ্ঠায় কাঁপছিল। “মা”, সে বলল, “আজকে রাতে আমি বাসায় খাব না। আমি কোনো একটা হোটেলে কিছু খেয়ে নিব আর প্যালেস টকিস-এর দুটো শোই দেখব।”
বিনায়ক স্ট্রিট থেকে বের হবার পর সে দেখল একদল ছেলে মার্কেট স্ট্রিট ধরে কেেলজের দিকে যাচ্ছে। কেউ একজন জিজ্ঞেস করল: “ঈশ্বরণ, রেজাল্ট দেখতে যাচ্ছ নাকি?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাচ্ছি। কিন্তু তার আগে আমাকে জরুরি একটা কাজে যেতে হবে।”
“কোথায়?”
“প্যালেস টকিস।” এ কথায় সবকটা ছেলে সমস্বরে হেসে উঠল। “মনে তো হচ্ছে তুমি এর মধ্যেই তোমার রেজাল্ট জেনে গেছ।”
“হ্যাঁ। না জানলে তোমাদের কী মনে হয় আমি ছবির সাথে এটা উদযাপন করতাম?”
“তোমার নম্বর কী?”
“সাত-আট-পাঁচ”, সে বলল; মাথায় প্রথম আসা সংখ্যার রাশিটাই বলে দিল সে।
দলের ছেলেরা বলতে থাকল, ঠাট্টা করে, “এবার তো তুমি ফার্স্ট ক্লাসই পাবে, আমরা জানি।”
ঈশ্বরণ চার-আনা ক্লাসের পেছনের দিকের কোণার একটা সিটে বসল। সে চারিদিকে তাকাল: পুরো থিয়েটারে আর একটা ছাত্রও নেই। শহরের সব ছাত্ররা ছিল সিনেট হাউসের পাশে, রেজাল্টের জন্যে অপেক্ষারত। পুরো থিয়েটারে একমাত্র ছাত্র হওয়ায় ঈশ্বরণের খুব খারাপ লাগল। নিজের প্রতি রীতিমত বিতৃষ্ণা হতে লাগল তার।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাতি বন্ধ হয়ে গেল আর শো শুরু হল। চেনা সব দেবতাদের নিয়ে একটি তামিল ছবি। শীঘ্রই সে নিজেকে দেব-দেবীদের রাজনীতি আর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝে হারিয়ে ফেলল। এক স্বর্গীয় জগতের দৃশ্য, যা কোনো পরিচালক দেখানোর জন্য বেছে নিয়েছিলেন, দেখে সে মোহাবিষ্ট হয়ে বসে রইল। অবশ্য এই বিস্মৃতির আনন্দ মাত্র আধঘণ্টা স্থায়ী হল। এর পরই ছবির নায়িকা স্বর্গের একটা গাছের নিচু এক ডালে উঠে বসলেন এবং সেই জায়গা থেকে আর সরার নামই নিলেন না। তিনি আধ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে সেখানে বসে গান গাইতে লাগলেন। এই অংশটা ঈশ্বরণকে ক্লান্ত করে দিল। আর তখনই ফিরে এল তার পুরানো সব বেদনা ও হতাশা । “ওহ্, ভদ্রমহিলা,” ঈশ্বরণ আবেদন করল, “আমার দুঃখ-দুর্দশা আর না বাড়িয়ে দয়া করে সরে যান।” ঈশ্বরণের অনুরোধ শুনেই যেন বা তিনি সরে গেলেন আর উজ্জ্বলতর ঘটনা তার অনুগামী হল। যুদ্ধ, মহাপ্লাবন, মেঘের দেশ থেকে একজন হঠকারীকে ফেলে দেওয়া, কারও সমুদ্র থেকে উঠে আসা, আগুনের বৃষ্টি, পুষ্পবৃষ্টি, মানুষের মৃত্যু, মানুষের কবর থেকে উঠে আসা–এমন অনেক কিছুই ঘটল। তামাকের ধোঁয়ার আচ্ছাদনের পেছনে থাকা সাদা পর্দায় এমন অনেক রোমাঞ্চকর দৃশ্যের অবতারণা হল। পর্দায় থেকে থেকে দেখানো লাগাতার বকবকানি, সঙ্গীত আর চিৎকার, সোডা বিক্রয়রত ফেরিওয়ালাদের হাঁক, দর্শকদের অসংযত মন্তব্য–এইসব হইচই আর উত্তেজনা কয়েক ঘণ্টার জন্য ঈশ্বরণকে সিনেট হাউস আর তার ছাত্রজীবনকে ভুলে থাকতে সাহায্য করল।
শো শেষ হল রাত দশটায়। রাতের শো-এর অপেক্ষায় অনেকেই গেটের সামনে ভিড় করে ছিল। ঈশ্বরণ প্যালেস টকিস-এর উল্টোদিকের একটা রেস্টুরেন্ট ’আনন্দ ভবন’-এর দিকে হাঁটতে লাগল। দোকানের মালিক বোম্বের অমায়িক ভদ্রলোকটি, যিনি কিনা ঈশ্বরণের বন্ধুও ছিলেন, হাঁক দিলেন, “ঈশ্বর সাহেব, রেজাল্ট তো আজকে জানানো হল। তোমারটার খবর কী?”
“এ বছর আমি কোনো পরীক্ষা দেইনি,” ঈশ্বরণ বলল।
“কেন, কেন, আমি তো জানতাম তুমি পরীক্ষার ফি দিয়েছিলে!”
ঈশ্বরণ হাসল, “তুমি ঠিকই জানো। আমি এই বিকেলেই ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছি।”
“বাহ্, খুব ভালো। তুমি না জানি কত বুদ্ধিমান! তুমি যদি হনুমানজির কাছে প্রার্থনা কর তাহলে তিনি সবসময় তোমাকে সাফল্য এনে দিবেন। এরপর তুমি কী করবে?”
“আমি আরও উঁচু ক্লাসে উঠব, এই আর কি,” ঈশ্বরণ বলল। সে দু-চার ধরনের মুখরোচক খাবার আর কফির অর্ডার দিয়ে যাবার জন্য উঠল। সে যখন বিল দিয়ে বের হতে যাচ্ছিল তখন হোটেলের মালিক বলে উঠলেন, “তোমার এই সাফল্য উপলক্ষে যদি কোনো অনুষ্ঠান কর তাহলে আমাকে আবার বাদ রেখ না কিন্তু।”
ঈশ্বরণ আবার একটা টিকেট কিনল আর ছবি দেখতে গেল। আরেকবার তার সামনে দেবতাদের শত্র“তা, বিবাদ আর ষড়যন্ত্রের পুনরাবৃত্তি ঘটল। সে আবার সেসবের মাঝে ডুবে গেল। যখন সে পর্দায় দেখল তার বয়েসী কিছু ছেলে দূরের কোনো স্বর্গের জলে গান গাইতে গাইতে খেলছে, সে বলল, “তোমরা তো এমন করতেই পারো। তোমরা যেখানে আছ সেখানে নিশ্চয়ই কোনো পরীক্ষা নেই…” আর সেই জগতের অংশ হবার আকাক্সক্ষা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল।
এরপর নায়িকা আবার গাছের ডালে বসে গান গাইতে শুরু করলেন আর ঈশ্বরণও ছবির উপর থেকে সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। প্রথমবারের মত সে চারিদিক দেখল। আধো-অন্ধকারেও সে লক্ষ্য করল, ছেলেদের বেশ কয়েকটা দল হলে আছে–আনন্দিত দল। সে জানত, ওরা সবাই নিশ্চয়ই নিজেদের রেজাল্ট দেখেছে আর এখন এসেছে নিজেদের সাফল্য উদযাপন করতে। সেখানে অন্তত পঞ্চাশজন ছেলে ছিল। সে জানত, ওরা সবই নিঃসন্দেহে খুব সুখি আর আনন্দিত, ঠোঁট লাল করে রেখেছে পান চিবিয়ে। সে জানত, আলো জ্বলে উঠবার সাথে সাথেই সে হবে ওদের সবার মনযোগের কেন্দ্রবিন্দু। ওরা সবই ওকে ওর রেজাল্ট নিয়ে জ্বালাতন করা শুরু করবে–আবার শুরু হবে সেই পুরানো একঘেয়ে ঠাট্টা আর ওর বেপরোয়া হবার ক্লান্তিকর অভিনয়। পুরো ব্যাপারটার উপরই সে বিরক্ত হয়ে উঠল। এই সফল মানুষগুলোর হাসিখুশি চেহারা আর তাদের কটাক্ষ–এসবের কিছুই আর সহ্য করার শক্তি নেই তার। সে নিশ্চিত ছিল যে তারা সবাই তার দিকে এমনভাবে তাকাবে যে এই দিনে ওর ছবির মাঝে আনন্দ খুঁজে বেড়ানোর কোনও কারণ নেই।
ঈশ্বরণ হলের আরও বেশি অন্ধকার একটা কোণের দিকে সরে আসল। সে পর্দার দিকে তাকাল–তাকে আনন্দ দেবার মত কিছুই সেখানে নেই: নায়িকা এখনও বসে আছে আর সে জানত যে নিঃসন্দেহে আগামী বিশ মিনিট ধরে সে সেখানেই বসে তার ‘মাস্টারপিস’টি গাইতে থাকবে… ঈশ্বরণ হতাশ হয়ে গেল। সে উঠে দাঁড়ালো, নিঃশব্দে একধার দিয়ে দরজার দিকে যেতে লাগল আর কিছুক্ষণের মধ্যেই থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসল। সেই কৃতকার্য ছেলেগুলোকে দেখে তার নিজের প্রতিই ঘৃণা জন্মালো। “আমি বাঁচার উপযুক্ত না। যে একটা পরীক্ষাও পাশ করতে পারে না…” হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি এল–তার সকল সমস্যার চমৎকার সমাধান–মারা যাওয়া এবং এমন এক জগতে যাওয়া যেখানের ছেলেরা পরীক্ষা থেকে মুক্ত, যারা স্বর্গোদ্যানের পদ্মপুকুরে খেলে বেড়ায়। কোনো ঝামেলা নাই, বছরের পর বছর নিরাশা নিয়ে তাকিয়ে থাকার জন্য কোনো জঘন্য সিনেট হাউস নেই। এই সমাধান হঠাৎ তাকে কেমন এক মুক্তির অনুভূতি এনে দিল। তার নিজেকে খুব হালকা লাগছিল। সে হোটেলের দিকে হাঁটতে শুরু করল। হোটেলের লোকটি তখন সব বন্ধ করে ঘুমাতে যাচ্ছিল। “শেঠজি”, ঈশ্বরণ বলল, “এই সময়ে আপনাকে জ্বালাতন করার জন্য মাফ করে দেন। আমাকে একটু কাগজ আর একটা পেন্সিল দিতে পারবেন? আমার জরুরি একটা জিনিস লিখতে হবে।” “এত রাতে…” লোকটি বলতে বলতে ওকে এক টুকরো কাগজ আর একটা ক্ষয়ে যাওয়া পেন্সিল এনে দিল। ঈশ্বরণ ওর বাবার জন্য একটা বার্তা লিখে খুব সতর্কভাবে কাগজটা ভাঁজ করে নিজের কোটের পকেটে রেখে দিল।
পেন্সিলটা ফেরত দিয়ে সে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলো। সে মাত্র রেসকোর্স রোডের নাগাল পেল, তারপর ডানে গেলেই আছে আঁকাবাঁকা মার্কেট রোড, তারপর আছে এলামেন স্ট্রিট আর তারপর সরযু। সরযু… যার কালো পাঁক-খাওয়া জল ওর সমস্ত দুঃখের অবসান ঘটাবে। “আমাকে এই চিঠিটা কোটের পকেটে রাখতে হবে আর মনে করে কোটটা নদীর তীরে রেখে যেতে হবে”, সে নিজেকে বলল।
সে শীঘ্রই এলামেন স্ট্রিট পার হয়ে আসল। তার পা নদীতীরের বালি চষে বেড়াতে লাগল। নদীর পাশে ধাপগুলোর কাছে এসে সে চটপট তার কোটটা খুলে নেমে যেতে লাগল। “ঈশ্বর”, হাতজোড় করে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বিড়বিড় করতে লাগল, “দশ বারের চেষ্টায়ও যদি আমি একটা পরীক্ষা পাশ না করতে পারি, তাহলে আমার এই পৃথিবীর অপমান বাড়িয়ে বেঁচে থাকার দরকার কী?” ওর পা তখন পানিতে ডোবানো ছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে সে ইউনিভার্সিটির দালানগুলোর দিকে তাকাল। সিনেট হাউসের বারান্দায় তখনো আলো জ্বলছিল। প্রায় মাঝরাত হয়ে আসছে–এখান থেকে সেখানে হেঁটে যেতে মিনিট পনের লাগবে। এখন যেয়ে শেষবারের মত নোটিশবোর্ডটা দেখে আসলে কেমন হয়? সে তো মারাই যাচ্ছে। সে কেন বোর্ডটা এড়িয়ে যাবে আর কেনই বা সেটার সামনে যেতে ভয়ে কাঁপবে?
সে পানি থেকে বেরিয়ে ধাপ বেয়ে উঠতে লাগল। কোটটা পেছনে ফেলে রেখেই সে বালুর মধ্য দিয়ে হাঁটতে লাগল। মাথার উপর তারা জ্বলছিল। কোথাও ঘড়িতে বারোটা বাজার শব্দ, নদীর জলের অস্পষ্ট ঝির ঝির শব্দ আর তীরের ঝোপগুলো থেকে রাতে শুনতে পাওয়া যায় এমন নানান শব্দ ভেসে আসছিল। ঈশ্বরণের ভেজা, ধুলো-ঢাকা পা ছুঁয়ে বাতাস বয়ে গেল। দোদুল্যমান মন নিয়ে সে সিনেট হাউসের বারান্দায় এসে ঢুকল। “আমার এখানে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই”, সে অস্পষ্টস্বরে বলল। সিনেট হাউস তখন ছিল একেবারেই জনশূন্য, একটা শব্দও শোনা যাচ্ছিল না। পুরো দালানটাই ছিল অন্ধকার, কেবল নিচের সিঁড়িকোঠা ছাড়া–সেখানে বড় একটা বাতি জ্বলছিল। আর দেয়ালে ঝুলছিল নোটিশবোর্ড।
ওর বুক ধড়ফড় করছিল যখন ও পা টিপে টিপে রেজাল্ট দেখতে এগুচ্ছিল। বাল্বের আলোয় সে সতর্কভাবে নাম্বারগুলো দেখতে লাগল। ওর গলা শুকিয়ে আসছিল। থার্ডক্লাসে যারা পাশ করেছে সে তাদের রোল নাম্বারগুলো দেখল। ওর নাম্বার ছিল ৫০১। তার আগের নাম্বারগুলোর মধ্য থেকে পাশ করা একজনের নাম্বার ৪৯৮, আর পরেরগুলো থেকে ৭০৩। “তাহলে আমার দুপাশের বন্ধুরাই এখানে আছে”, অনেকটা জোর করেই সে গলায় উচ্ছ্বাস নিয়ে এলো। সিনেট হাউসে আসবার সময় তার মনে এই আশা উঁকি দিচ্ছিল যে হয়ত তার নাম্বারটা কৃতকার্য পরীক্ষার্থীদের সারিতে থাকবে। সে অনুমান করেছিল এরপর তার অনুভূতি কী হত… সে তক্ষুনি ছুটে বাড়ি যেত আর সবাইকে বলত তাদের টিটকারিগুলো ফিরিয়ে নিয়ে ক্ষমা চাইতে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ যাবত নোটিশবোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকবার পর তার উপর অকৃতকার্যতার কঠোর ছায়া নেমে আসল: তার নাম্বার কোথাও ছিল না। “সরযু…”, সে বলল। তার নিজেকে এমন এক নিরুপায় আসামীর মত মনে হচ্ছিল যাকে অপ্রত্যাশিতভাবে মুক্তির নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল কিন্তু ভুল করে। “সরযু”, ঈশ্বরণ বলল, “আমি যাচ্ছি সরযুতে” সে যেন নোটিশবোর্ডটাকেই এ কথা বলে কয়েক ধাপ পিছিয়ে গেল। “কয়জন অনার্স পেল তা তো দেখা হল না।” সে আবার নোটিশবোর্ড দেখতে গেল। সে উপরের দিকের কলামগুলোতে চোখ বুলাল। আশ্চর্যজনকভাবে এক নাম্বার রোলওয়ালা এক ছেলে ফার্স্টক্লাস পেয়েছে, সঙ্গে আরও ছয়জন। “কীভাবে যে এরা ফার্স্টক্লাস পেল কে জানে”, ঈশ্বরণ প্রশংসার সুরে বলে। ওর চোখ সেকেন্ড ক্লাসের দিকে গেল– ৯৮ দিয়ে শুরু করে দুই লাইনেই নাম্বারগুলো লেখা। প্রায় পনেরজনের নাম্বার ছিল। পরের নাম্বারটিতে যাবার আগে সে প্রতিটা নাম্বার মনযোগ দিয়ে দেখছিল। সে ৩৫০-এ এসে থামল। তারপর ৪০০, তারপর ৫০১ আর তারপর ৬০০।
“পাঁচ-শূন্য-এক সেকেন্ড ক্লাসে! এটাও কি সত্যি হতে পারে?” সে চিৎকার করে উঠল। সে বারবার নাম্বারটা দেখতে লাগল। হ্যাঁ, নাম্বারটা সেখানেই ছিল। ঈশ্বরণ সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছে। “এটা যদি সত্যি হয় তাহলে সামনের মাসে আমি বি,এ ক্লাসে থাকব!” সে চেঁচিয়ে উঠল। নীরব দালানগুলোর মাঝে তার কণ্ঠ প্রতিধ্বনি তুলল। “ছাল ছাড়িয়ে ফেলব তার এরপর থেকে যে আমাকে বোকা বলবে”, সে ঘোষণা করল। ওর মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগল। এত বছরের খাটুনি আর উৎকণ্ঠা হঠাৎ শিথিল হয়ে গেল। এই শৈথিল্যের চাপ সহ্য করতে ওর কষ্টই হচ্ছিল। ওর শিরা-উপশিরা দিয়ে রক্ত দ্রুতবেগে ছুটে এসে মাথায় যেন ধাক্কা দিয়ে যেতে লাগল। ও অনেকটা জোর করেই নিজেকে শান্ত করল। তারপর গুন গুন করে আপনমনেই একটা সুর ভাঁজতে লাগল। ওর মনে হচ্ছিল যে ও পৃথিবীর একমাত্র বাসিন্দা, এবং এর একচ্ছত্র অধিপতি। ও বুক চাপড়ে নোটিশবোর্ডকে উদ্দেশ্য করে বলল, “জানো, আমি কে?” কোনো এক কাল্পনিক গোঁফে তা দিতে দিতে ও আপনমনে হেসে বলল, “ঘোড়া কি তৈরি হয়েছে, সহিস?”, সে নোটিশবোর্ডটার দিকে এমন এক বাঁকা চাহনি দিল যেন সেটা খুব তুচ্ছ আর তারপর রাজার মত গটগটিয়ে হেঁটে চলে গেল। বারান্দার শেষ সিঁড়িটাতে দাঁড়িয়ে সে তার ঘোড়াটাকে খুঁজতে লাগল। সে মিনিটখানিক অপেক্ষা করেই কাউকে যেন হুকুম করল, “ঘোড়াটাকে কাছে আন, নির্বোধ। কথা কানে যায় না?” ঘোড়াটাকে কাছে আনা হল। সে এমন ভঙ্গি করল যেন সে ঘোড়ায় চড়ছে। তারপর সে রাগের চোটে ঘোড়ার পিঠে চাবুক মারল। তার কণ্ঠ অন্ধকার নদীতীর জুড়ে প্রতিধ্বনি তুলল–সে শব্দ ঘোড়াকেও ছুটতে প্ররোচিত করল। সে হাত দুটো ছড়িয়ে তীর ধরে ছুটতে লাগল, যতটুকু সম্ভব নিজের গলা চড়িয়ে বলল, “সবাই সরে যাও, রাজা আসছেন। যে এই পথে আসবে তাকে পিষে ফেলা হবে…।”
“আমার পাঁচশ’ একটা ঘোড়া আছে”, সে যেন রাতকে উদ্দেশ্য করেই বলল। নাম্বারটা তার মনে গেঁথে ছিল আর বারবার উঠে আসতে লাগল। সে পুরো তীর ধরেই দৌড়ে বেড়াতে লাগল, বারবার। কিন্তু তাতেও তাকে সন্তুষ্ট মনে হল না। “প্রধানমন্ত্রী”, সে বলল, “এই ঘোড়াটা ভাল না। আমাকে আরও যে পাঁচশ’ একটা ঘোড়া আছে সেগুলো এনে দাও–সবগুলো সেকেন্ড ক্লাসে আছে।” সে যে ঘোড়াটায় চড়ছিল সেটাকে একটা লাথি দিয়ে নেমে পড়ল। প্রধানমন্ত্রী শীঘ্রই তাকে আরেকটা ঘোড়া এনে দিল। সে গাম্ভীর্য নিয়ে কাল্পনিক সেই ঘোড়াটায় উঠে বসল আর বলল “এই ঘোড়াটা আরও ভাল।” তারপর সে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বেড়াতে লাগল। দৃশ্যটা ছিল খুবই অদ্ভুত। তারার ক্ষীণ আলোতে, এত রাতে একলা সে মুখ দিয়ে ঘোড়ার খুরের ট্যাপ-ট্যাপ শব্দ অনুকরণ করে যাচ্ছিল। এক হাত লাগাম টেনে ধরার মত ঝুলিয়ে রেখে অন্য হাত দিয়ে সে তার গোঁফে তা দিচ্ছিল। সে ঘোড়াটাকে ততক্ষণ পর্যন্ত তাগাদা দিচ্ছিল যতক্ষণ না সেটা ঝড়ের বেগে ছুটতে শুরু করে। বাতাসের মাঝ দিয়ে ছুটে চলার সময় তার নিজেকে মনে হচ্ছিল দিগি¦জয়ী বীর। কিছুক্ষণের মধ্যে সে পুরো বালুরাশি পার হয়ে আসল। জলের একদম কিনারে এসে সে কিছুক্ষণ ইতস্তত করল, তারপর তার ঘোড়াকে বলল, “তুমি কি পানি ভয় পাও নাকি? তোমাকে সাঁতরে পার হতেই হবে। নাহলে কক্ষণও আমি তোমার জন্য পাঁচশ’ এক রুপি খরচ করব না।” তখন তার মনে হল ঘোড়াটা যেন একটা লাফ দিল।
পরদিন দুপুরে নদীতীর থেকে সিকিমাইল দূরে ঈশ্বরণের দেহ ভেসে উঠল। ইতোমধ্যেই কয়েকজন মিলে তীরে ফেলে যাওয়া ওর কোটটা তুলে নিয়েছিল আর সেটার ভেতরের পকেটে এক টুকরো কাগজ আবিষ্কার করেছিল যাতে লেখা ছিল–
“প্রিয় বাবা, তুমি যখন এই চিঠিটা পাবে ততক্ষণে আমি সরযুর তলায় থাকব। আমি বাঁচতে চাই না। আমাকে নিয়ে ভেবো না। তোমার তো আরও ছেলে আছে যারা আমার মত গর্দভ না…।”


সূত্র:-  arts.bdnews24.com

ডিকশনারী লাগবে ডিকশনারী, বাংলা ডিকশনারী

কম্পিউটারে কাজ করার সময় প্রায়ই আমাদের অজানা অনেক ইংরেজী শব্দের মুখোমুখি হতে হয়। সেসব ক্ষেত্রে ডিকশনারী খুলে অর্থ বের করা যেমন কষ্টকর তেমনি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এবং এতে কাজের গতিও কমে যায় অনেকাংশে।


“Silicon Dictionary” উন্নতমানের ইউজার ফ্রেন্ডলী ইন্টারফেস এবং শক্তিশালী সার্চ ইঞ্জিন সমৃদ্ধ ইংলিশ-টু-বেঙ্গলি ডিকশনারী। বাজারে অনেক ধরনের ডিকশনারী পাওয়া যায়। তবে তাদের সাথে সিলিকন ডিকশনারী -র পার্থক্য হল, এটি সম্পূর্ণ ফ্রি, ডাইনামিক সার্চ ইঞ্জিন এবং বাজারের যেকোন ডিকশনারী অপেক্ষা এর সার্চ ইঞ্জিনটি অধিক দ্রুতগতি সম্পন্ন। তাছাড়া, এর বাংলা অর্থগুলি image আকারে দেয়ায় আপনি পাবেন সত্যিকারের ডিকশনারীর স্বাদ। আর প্রতিটি ইংরেজী শব্দের উচ্চারনতো আছেই।

আশা করি পরিস্কার ধারনা পেয়েছেন। তারপরেও বলছি এই ডিকশনারির সব চেয়ে ভাল দিক হলো শব্দ সার্চ করার উচ্চ গতি। শশী বা অন্যান্য ডিকশনারি থেকে সিলিকনের গতি বেশি। এছাড়াও শব্দগুলোর মিনিং বেশ বিস্তারিত। শুদ্ধভাবে উচ্চারন জানারও সুযোগ আছে। speak বাটনে ক্লিক করলেই শুনতে পারবেন ইংরেজি শব্দের উচ্চারণ।
    
                                     এখান থেকে ডাউনলোড করুন

ইন্সটল করার সময় একটা error শো করতে পারে। তখন শুধু ignore এ ক্লিক করলেই হবে। 



আমা করি ভালো লাগবে.................................

হেলাল হাফিজের নির্বাচিত কবিতা

আজ কেন যেন মনটা ভালো নেয়। অনেক্ষন রবীন্দ্র সংগীত শোনার পরেও মনটা ভালো হল না। তাই হেলাল হাফিজের কিছু কবিতা শুনতে লাগলাম। মনটা একটু ভালো হল ...........
নেট অন করে লিখতে বসে গেলাম। লিখতে গিয়ে যত সমস্যা, বিজয়ে টাইপ করতে করতে ইউনিজয়ে টাইপ করতে ভালো লাগেনা। তাই কপি পেস্ট শুরু করলাম যদি আমার মতো কারো মন ভালো করে দিতে পারে সে আশায়............
 
 প্রস্থান
এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিয়ো৷
এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালী তাল পাখাটা
খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিয়ো৷
ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মতো খুব ব্যথিত
ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে, পত্র দিয়ো৷
কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে
কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে
পত্র দিয়ো, পত্র দিয়ো৷

আর না হলে যত্ন করে ভুলেই যেয়ো, আপত্তি নেই৷
গিয়ে থাকলে আমার গেছে, কার কী তাতে?
আমি না হয় ভালোবেসেই ভুল করেছি ভুল করেছি,
নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে
পাঁচ দুপুরের নির্জনতা খুন করেছি, কী আসে যায়?
এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে,
এক মানবী কতোটা আর কষ্ট দেবে
....................................
অনির্ণীত নারী

নারী কি নদীর মতো
নারী কি পুতুল,
নারী কি নীড়ের নাম
টবে ভুল ফুল।
নারী কি বৃক্ষ কোনো
না কোমল শিলা,
নারী কি চৈত্রের চিতা
নিমীলিত নীলা।
..................................................

অমিমাংসিত সন্ধি

তোমাকে শুধু তোমাকে চাই, পাবো?
পাই বা না পাই এক জীবনে তোমার কাছেই যাবো।
ইচ্ছে হলে দেখতে দিও, দেখো
হাত বাড়িয়ে হাত চেয়েছি রাখতে দিও, রেখো
অপূণতায় নষ্টে-কষ্টে গেলো
এতোটা কাল, আজকে যদি মাতাল জোয়ার এলো
এসো দু’জন প্লাবিত হই প্রেমে
নিরাভরণ সখ্য হবে যুগল-স্নানে নেমে।
থাকবো ব্যাকুল শর্তবিহীন নত
পরস্পরের বুকের কাছে মুগ্ধ অভিভূত।
 ..............................................................
ইচ্ছে ছিলো
 
ইচ্ছে ছিলো তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো
ইচ্ছে ছিলো তোমাকেই সুখের পতাকা করে
শান্তির কপোত করে হৃদয়ে উড়াবো।
ইচ্ছে ছিলো সুনিপূণ মেকআপ-ম্যানের মতো
সূর্যালোকে কেবল সাজাবো তিমিরের সারাবেলা
পৌরুষের প্রেম দিয়ে তোমাকে বাজাবো, আহা তুমুল বাজাবো।
ইচ্ছে ছিলো নদীর বক্ষ থেকে জলে জলে শব্দ তুলে
রাখবো তোমার লাজুক চঞ্চুতে,
জন্মাবধি আমার শীতল চোখ
তাপ নেবে তোমার দু’চোখে।
ইচ্ছে ছিল রাজা হবো
তোমাকে সাম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,
আজ দেখি রাজ্য আছে
রাজা আছে
ইচ্ছে আছে,
শুধু তুমি অন্য ঘরে।
................................................................................
একটি পতাকা পেলে
 
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস
ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন,–’পেয়েছি, পেয়েছি’।
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে
ওম নেবে জাতীয় সংগীত শুনে পাতার মর্মরে।
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
ভূমিহীন মনুমিয়া গাইবে তৃপ্তির গান জ্যৈষ্ঠে-বোশেখে,
বাঁচবে যুদ্ধের শিশু সসন্মানে সাদা দুতে-ভাতে।
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে,
সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ
সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে।
..................................................................
দুঃসময়ে আমার যৌবন

মানব জন্মের নামে হবে কলঙ্ক হবে
এরকম দুঃসময়ে আমি যদি মিছিলে না যাই,
উত্তর পুরুষে ভীরু কাপুরুষের উপমা হবো
আমার যৌবন দিয়ে এমন দুর্দিনে আজ
শুধু যদি নারীকে সাজাই।
......................................................
 
নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়
 
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
মিছিলের সব হাত
কন্ঠ
পা এক নয় ।
সেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিরাগী থাকে,
কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার ।
কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার
শাশ্বত শান্তির যারা তারাও যুদ্ধে আসে
অবশ্য আসতে হয় মাঝে মধ্যে
অস্তিত্বের প্রগাঢ় আহ্বানে,
কেউ আবার যুদ্ধবাজ হয়ে যায় মোহরের প্রিয় প্রলোভনে
কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনী হতে হয় ।
যদি কেউ ভালোবেসে খুনী হতে চান
তাই হয়ে যান
উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায় ।
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় ।
........................................
 
ফেরীওয়ালা
 
কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট !
লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
ঘরের কষ্ট পরেরর কষ্ট পাখি এবং পাতার কষ্ট
দাড়ির কষ্ট
চোখের বুকের নখের কষ্ট,
একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
প্রেমের কষ্ট ঘৃণার কষ্ট নদী এবং নারীর কষ্ট
অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট,
ভুল রমণী ভালোবাসার
ভুল নেতাদের জনসভার
হাইড্রোজনে দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
দিনের কষ্ট রাতের কষ্ট
পথের এবং পায়ের কষ্ট
অসাধারণ করুণ চারু কষ্ট ফেরীঅলার কষ্ট
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
আর কে দেবে আমি ছাড়া
আসল শোভন কষ্ট,
কার পুড়েছে জন্ম থেকে কপাল এমন
আমার মত ক’জনের আর
সব হয়েছে নষ্ট,
আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট ।
................................................................
ভূমিহীন কৃষকের গান

দুই ইঞ্চি জায়গা হবে?
বহুদিন চাষাবাদ করিনা সুখের।
মাত্র ইঞ্চি দুই জমি চাই
এর বেশী কখনো চাবো না,
যুক্তিসঙ্গত এই জৈবনিক দাবি খুব বিজ্ঞানসম্মত
তবু ওটুকু পাবো না
এমন কী অপরাধ কখন করেছি!
ততোটা উর্বর আর সুমসৃণ না হলেও ক্ষতি নেই
ক্ষোভ নেই লাবন্যের পুষ্টিহীনতায়,
যাবতীয় সার ও সোহাগ দিয়ে
একনিষ্ঠ পরিচর্যা দিয়ে
যোগ্য করে নেবো তাকে কর্মিষ্ঠ কৃষকের মত।
একদিন দিন চলে যাবে মৌসুম ফুরাবে,
জরা আর খরায় পীড়িত খাঁ খাঁ
অকর্ষিত ওলো জমি
কেঁদে-কেটে কৃষক পাবে না।
............................................................

রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০১১

ও. হেনরীর ছোট গল্প : দি লাস্ট লিফ

ওয়াশিংটন স্কয়ারের পশ্চিমে এক ছোট জেলা, যেখানে রাস্তাগুলো অনিরাপদভাবে ছুটে চলেছে এবং ভেঙে ভেঙে নিজেদের ভিতরে ছোট ছোট ‘গলি’ তৈরী করেছে। এই গলিগুলোতে গড়ে উঠেছে অদ্ভুত সব কোণা কানছি আর বাঁক। একটি রাস্তা নিজের উপর দিয়ে এক দুইবার করে অতিক্রম করে গেছে। একবার এক চিত্রশিল্পী এই রাস্তাটির মাঝে এক মূল্যবান সম্ভাবনা আবিষ্কার করে বসলেন। মনে করুন, একজন সংগ্রাহক রঙ, কাগজ এবং ক্যানভাসের জন্য বিল সাথে নিয়ে এই পথের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, হঠাৎকরে দেখল সে আগের জায়গায়ই ফিরে এসছে, এর জন্য তাকে এক পয়সাও খরচ করতে হয় নি!
তাই, চিত্রশিল্পীরা খুব তাড়াতাড়ি ঘুরতে ঘুরতে এই অদ্ভুত পুরনো গ্রিনিচ গ্রামে চলে এল, খুঁজে বের করল উত্তর দিকের জানালাসহ আঠার শতকের পুরনো গ্যাবল (ডাচ গ্যাবল জ্যাকোবিয়ান সময়ের ইংল্যান্ডের বিশেষ স্থাপত্যের বাড়ী), কম ভাড়ায় এক ডাচ চিলেকোঠা। এরপর তাঁরা ছয় নম্বর এভিনিউ থেকে রান্না করা ও খাবার গরম রাখার জন্য চুল্লিযুক্ত দুই একটি পাত্র এবং কিছু পিউটর মগ নিয়ে এসে এখানে কলোনি গড়ল।
তিন তালা পাকা বাড়িটির নীচ তলায় ছিল সিউ ও জনসির স্টুডিও। ‘জনসি’ জোয়ান্না নামে পরিচিত ছিলেন।  একজন এসেছিল মেইন থেকে, অন্যজন ক্যালিফোর্নিয়া। আট নম্বর স্ট্রীটের “ডেলমনিকো’স” হোটেলের খাবার টেবিলে তাঁদের পরিচয় হল এবং তাঁরা দেখলেন শিল্প, চিকরি সালাদ ও বিশপ স্লিভ (ফুল হাতার জামা বিশেষ) এ তাঁদের রূচির অনেক মিল, যার ফলশ্রুতিতে এই যৌথ স্টুডিওটি দাঁড়িয়ে গেল।
সময়টা ছিল মে মাস। নভেম্বরে এক শীতল, অদেখা আগন্তুক, যাকে ডাক্তাররা ডাকত নিউমোনিয়া, কলোনিতে জেকে বসল, তাঁর হিমশীতল আঙুলগুলো এখানে সেখানে স্পর্শ করল। এই ধ্বংসকারী দুঃসাহসিকভাবে লম্বা লম্বা পা ফেলে পূর্ব দিকে এগোলেন, তার শিকারকে আঁচড় বসিয়ে সজোরে আঘাত করলেন, কিন্তু এই সরু ও শেওলা পড়া গোলক ধাঁধার ‘গলি’ দিয়ে তার পা আস্তে আস্তে পথ মাড়াল।
একজন আদর্শ নাইট, বয়স্ক সজ্জন ব্যক্তিকে আপনি যা ডাকতে পারেন, নিউমোনিয়া সাহেব তেমনটি নন। ক্যালিফোর্নিয়ার মৃদুমন্দ পশ্চিমা বায়ুর সহানুভূতির পাত্র রক্তশূন্য ছোট মেয়েটি ছিল লাল মুঠো, স্বল্পস্থায়ী শ্বাস-প্রশ্বাসের নির্বোধ বুড়োটার জন্য নামেমাত্র বৈধ আক্রমণস্থল। তাই জনসিকে সে সজোরে আঘাত করে বসল; জনসি বিছানায় পড়ে গেল, হাঁটা চলা করত না বললেই চলে, নিজের আলপনা আঁকা লোহার খাটে শুয়ে শুয়ে ছোট ডাচ জানালার শার্সির কাচের ভিতর দিয়ে সামনের পাকা বাড়িটার শূন্য দিকটায় চেয়ে থাকত।
একদিন সকালে সিউয়ের আমন্ত্রণে উস্কখুস্ক, ধূসর ভ্রু’র এক ব্যস্ত ডাক্তার বিল্ডিংয়ে এলেন।
“তাঁর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দশে এক ”, ডাক্তার তাঁর ক্লিনিক্যাল থার্মোমিটারের পারদ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন, “এবং তাঁর জন্য এই সম্ভাবনাটি হল তাঁর নিজের বেঁচে থাকার ইচ্ছা। শেষ সীমানায় পৌছে যাওয়া মানুষ জন এই উপায়েই আবার ফিরে আসে – যে সীমানায় মৃত্যুদূত সমগ্র ফার্মাকোপিডিয়াকে নিরর্থক বানিয়ে ফেলে। আপনার এই ছোট মেয়েটি নিজের মনকে বুঝিয়েছে সে আর সুস্থ হতে যাচ্ছে না। তাঁর মনে এছাড়া আর অন্যকিছু আছে কি?”
“সে – সে কিছুদিন নেপলস উপসাগরকে আঁকতে চেয়েছিল।”, সিউ বলল।
“চিত্রাঙ্কণ? – নাহ! তাঁর মনে গুরুত্বপূর্ণ কোনো চিন্তা দুইবার এসেছিল কি – যেমন ধরুন কোনো মানুষকে নিয়ে?”
“কোনো মানুষ?”, জিউ’স হার্পের (এক ধরণের বাদ্য বিশেষ) টুং টাং শব্দের মত কর্কশ নাকি সুরে সিউ বলল, “কোনো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ – কিন্তু, না, ডাক্তার; এমন কিছু হয় নি।”
“আচ্ছা, এটাই তাহলে তাঁর দুর্বলতা”, ডাক্তার বলল। “আমার সামর্থ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব, বিজ্ঞান অনুসারে আমি তার সবটুকুই করব। কিন্তু যখনই আমার রোগী তাঁর শব যাত্রার দিন গুনতে শুরু করবে, আমি ঔষধের উপশম-সহায়ক ক্ষমতা অর্ধেকে নামিয়ে নিয়ে আসবো। নতুন শীতের ধরনে তাঁর ক্লোক স্লিভে (ফুল হাতার আলখাল্লা বিশেষ) কেমন লাগছে যদি আপনি তাঁকে প্রশ্নটি  জিজ্ঞাসা করতে পারতেন, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি তাঁর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে দশে একের পরিবর্তে পাঁচে এক হবে।”
ডাক্তার চলে গেলে, সিউ তাঁর ওয়ার্করুমে গিয়ে নরম জাপানী ন্যাপকিনে মুখ ঢেকে কাঁদলেন। এরপর সে তাঁর ড্রয়িং বোর্ড নিয়ে তর্জন গর্জন করতে করতে জনসির রুমে গিয়ে সিটি বাঁজিয়ে র‍্যাগটাইম (১৯২০ এর দশকের নিগ্রোদের জনপ্রিয় গান) গাইতে লাগলেন।
জনসি কাঁথার নিচে বড়ো জোর একটু নড়াচড়া করে, জানালার দিকে মুখ করে শুয়ে রইল। সিউ সিটি বাঁজানো থামিয়ে ভাবলেন, জনসি ঘুমিয়ে আছে।
সে তাঁর বোর্ড সাজিয়ে ম্যাগাজিনের গল্প ফুটিয়ে তোলার জন্য কলম-কালি দিয়ে চিত্র আঁকতে শুরু করলেন। একজন নবীন চিত্রশিল্পীকে শিল্পকলায় প্রতিষ্ঠা পেতে হলে অবশ্যই ম্যাগাজিনের গল্পের জন্য চিত্র আঁকতে হয়, যেমন একজন নবীন লেখককে প্রতিষ্ঠা পেতে গল্প লিখতে হয় ম্যাগাজিনের জন্য।
সিউ ঘোড়-দৌড়ে পড়ার জন্য এক জোড়া রুচিশীল পায়জামা এবং গল্পের নায়ক, এক ইডাহো (যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য) রাখালের একপার্শ্বিক চিত্রের স্কেচ আঁকছিলেন, তখন সে বেশ কয়েকবার পুনরাবৃত্তিসহ নিচু স্বরের একটি শব্দ শুনতে পেলেন। সে দ্রুত বিছানার পাশে ছুটে গেলেন।
জনসির চোখ পুরোপুরি খোলা ছিল। সে জানালার বাইরে তাঁকিয়ে গুনছিল – উল্টো দিক থেকে গননা।
“বারো”, সে বলল, এবং অল্প সময় পরে, “এগারো”; এরপর “দশ”, “নয়”; “আট”, সাত”, প্রায় এক সাথেই।
সিউ উৎকণ্ঠিতভাবে জানালার বাইরে তাঁকালো। কি আছে সেখানে গোনার মতো? সেখানে দেখা যাচ্ছিল এক শূন্য, বিষণ্ণ উঠোন, এবং কুড়ি ফুট দূরে এক পাকা বাড়ির শূন্য অংশ। একটি পুরনো, গাঁটযুক্ত ও ক্ষয়ে যাওয়া শিকড়যুক্ত বয়স্ক আইভি লতা ইটের দেয়ালের অর্ধেকটায় বেয়ে উঠেছিল। পরিত্যক্ত ইটের দেয়ালে প্রায় শূন্য লতাটির কাঠামো প্রশাখা দৃঢ়ভাবে লেগেছিল, যতক্ষন পর্যন্ত না হেমন্তের শীতল হাওয়া লতাটি থেকে পাতাগুলোকে দুর্বল করে ফেলেছিল।
“কি করছো, সোনা?” সিউ জিজ্ঞাসা করল।
“ছয়”, প্রায় ফিসফিস করে বলল জনসি। “ওরা এখন খুব দ্রুত পড়ে যাচ্ছে। তিন দিন আগেও প্রায় একশটা ছিল। ওগুলো গুনতে গুনতে আমার মাথাটা ধরে এসেছিল। কিন্তু এখন সহজ হয়ে এসেছে। আরেকটা পড়ে গেল। এখন আর মাত্র পাঁচটি বাকি আছে।”
“পাঁচটি কি, সোনা? তোমার সিউডিকে বলো?”
“পাতা। আইভি লতার। যখন শেষ পাতাটি পড়ে যাবে, আমিও অবশ্যই চলে যাবো। তিন দিন হল এটি আমি জেনেছি। ডাক্তার কি তোমাকে বলে নি?”
“ওহ! এই ধরনের অর্থহীন কথা আমি আর কখনো শুনি নি,” আশ্চর্যরকম অবজ্ঞার সুরে অভিযোগ করে বলল সিউ। “তোমার সুস্থ হয়ে যাওয়ার সাথে বুড়ো আইভি পাতার কি সম্পর্ক? তুমি ঐ লতাকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছো, দুষ্ট মেয়ে। বোকার মত আচরন করো না। কেন, ডাক্তার তো আজ সকালেই আমাকে বলল তোমার দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবার ভালো সম্ভাবনা আছে – মনে আছে তোমার, ডাক্তার ঠিক কি বলেছিল – সে বলল, সম্ভাবনা দশে এক! কেন, এটা তো প্রায়ই একটি ভালো সম্ভাবনা হতে পাড়ত যদি আমরা নিউ ইয়র্কে স্ট্রিট কারে চড়ে ঘুরে বেড়াতাম অথবা একটি নতুন বিল্ডিংয়ের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতাম। এখন কিছুটা স্যুপ খাওয়ার চেষ্টা করো এবং তোমার সিউডিকে তাঁর ড্রয়িংয়ের কাছে আবার ফিরে যেতে দাও, যাতে সে ওগুলো সম্পাদক সাহেবের কাছে বিক্রি করে তাঁর অসুস্থ বাচ্চাটার জন্য পোর্ট ওয়াইন (পর্তুগালের গাঢ় লাল বা সাদা, উগ্র, মিষ্ট মদ বিশেষ) এবং নিজের জন্য লোভনীয় শুকরের চপ কিনতে পারে।”
“তোমাকে আর ওয়াইন কিনতে হবে না,” জানালার বাইরের তাঁর দৃষ্টি স্থির রেখে, জনসি বলল। “আরেকটা পড়ে গেল। না, আমি কোনো স্যুপ চাই না। আর মাত্র চারটা পাতা আছে। অন্ধকার নেমে আসার আগেই আমি শেষ পাতাটির পড়ে যাওয়া দেখতে চাই। এর পরে আমিও চলে যাবো।”
“জনসি, সোনা,” তাঁর উপর নুয়ে পড়ে সিউ বলল, “তুমি কি আমাকে কথা দিবে, তোমার চোখদুটো বন্ধ রাখবে, এবং যতক্ষন পর্যন্ত আমার কাজ শেষ না হয় তুমি জানালার বাইরে তাঁকাবে না? আমাকে ছবিগুলো কালকেই জমা দিতে হবে। আমার আলো দরকার, না হলে আমি পর্দা টেনেই আঁকতাম।”
“তুমি অন্য রুমে গিয়ে আঁকতে পারো না?” নিষ্প্রাণভাবে বলল জনসি।
“আমাকে এখানে তোমার পাশেও থাকতে হবে,” সিউ বলল। “এছাড়া, আমি চাই না তুমি ঐসব তুচ্ছ আইভি পাতার দিকে তাঁকিয়ে থাকো।”
“তোমার কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই আমাকে বোলো,” ফ্যাকাশে ও ভূপতিত স্ট্যাচুর মত শুয়ে থেকে, চোখদুটো বন্ধ রেখে জনসি বলল, “কারন আমি শেষ পাতাটির পড়ে যাওয়া দেখতে চাই। আমি অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত। আমি ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত। আমি সকল বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে চাই, ক্রমশ ডুবে যেতে চাই, ঠিক ঐসব নিঃস্ব, ক্লান্ত পাতাগুলোর মত।”
“ঘুমোতে চেষ্টা করো,” সিউ বলল। “বৃদ্ধ নির্জনবাসী খনি-শ্রমিকের মডেল হবার জন্য আমাকে বেহরম্যানকে ডাকতে যেতেই হবে। আমার যেতে এক মিনিটও লাগবে না। আমি না ফেরা পর্যন্ত নড়াচড়ার চেষ্টা করো না।”
বৃদ্ধ বেহরম্যান ছিলেন একজন পেইন্টার, যিনি তাঁদের নিচে গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকতেন। ষাট পেরোনো এই বুড়োর মাইকেল এঞ্জেলোর ‘মোজেসে’র মত দাড়ি ছিল, যেন স্যাটারের মাথা থেকে কোঁকড়িয়ে নিচে নেমে এসেছে এবং দেহখানা খুদে শয়তানের মতো। (ইতালীর বিখ্যাত চিত্রকর ও ভাস্কর মাইকেল এঞ্জেলোর ভাস্কর্য ‘মোজেস’; দুই সুশোভিত মার্বেল স্তম্ভের মাঝখানে মার্বেল চেয়ারে বসা মোজেস, যার দীর্ঘ দাড়ি কোলের উপরে এসে পড়েছে। মোজেস ইসলাম ধর্মে মুসা নবী নামে পরিচিত ও ইহুদী ধর্মের প্রবর্তক। স্যাটার গ্রীক ও রোমান পুরানে উল্লেখিত অর্ধমানব ও অর্ধপশুরূপী বনদেবতা।) বেহরম্যান চিত্রশিল্পে ছিলেন ব্যর্থ। চল্লিশ বছর ধরে ব্রাশ ঘষেও তাঁর গিন্নীর গাউনের আঁচলের কাছাকাছি কিছু একটা আঁকতে পারেন নি। সে সবসময় তাঁর শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মটি আঁকার কথা ভাবত, কিন্তু কখনোই সেটা শুরু করতে পারে নি। বেশ কয়েক বছর ধরে, কিছু ইতঃস্তত বাণিজ্যিক ও বিজ্ঞাপনী আনাড়ি চিত্র আঁকা ছাড়া তেমন কিছুই করতে পারে নি সে। কলোনির নবীন আঁকিয়ে যাদের পেশাদার চিত্রশিল্পীর মতো অর্থ দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না, তাঁদের মডেল হিসেবে কাজ করে সে অল্প কিছু উপার্জন করত। সে মাত্রাতিরিক্ত জিন (মদ বিশেষ) পান করত এবং সবসময় তাঁর আসন্ন শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মটি সম্পর্কে কথা বলত। বাকিটা সময় সে ছিল একজন রাগী ছোটখাটো বুড়ো মানুষ, অন্যের স্নেহ-মমতা পাওয়ার জন্য যে ছিল ক্ষুধার্ত, এবং নিজেকে গণ্য করেছিল অপেক্ষমান বিশেষ মাস্টিফ (প্রহরাকাজে দক্ষ, বড় আকারের শক্তিশালী কুকুর বিশেষ) হিসেবে যে উপরের স্টুডিওটির দুই নবীন চিত্রশিল্পীকে বাঁচাতে যাচ্ছিলেন।
সিউ বেহরম্যানকে তাঁর অনুজ্জ্বলভাবে আলোকিত আস্তানায় প্রবলভাবে জুনিপার (চিরসবুজ গুল্ম বিশেষ) ফলের ঘ্রাণ নিতে দেখতে পেলেন। এক কোণায় কাঠের ফ্রেমে একটি শূন্য ক্যানভাস সাজানো ছিল, শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মটির রূপ পেতে প্রথম রেখাটির জন্য যা পচিশ বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে। সিউ বেহরম্যানকে জনসির অবাস্তব কল্পনার কথা বলল, বলল কতটা শঙ্কিত দেখাচ্ছে তাঁকে, নিজেকে তুচ্ছ ও ঠুনকো পাতার মত ভাবছে,  ভেসে চলে যাচ্ছে দূরে, পৃথিবীর প্রতি তাঁর ক্ষুদ্র বন্ধন ক্রমশ দুর্বলতর হচ্ছে।
বুড়ো বেহরম্যানের রক্তিম চোখদুটোতে অশ্রুর বন্যা বেয়ে গেল, সে চেঁচিয়ে এই নির্বোধ ধরনের কল্পনাকে অবজ্ঞা ও উপহাস করল।
“ধুর!” সে কেঁদে ফেলল। “পৃথিবীতে এমন লোকও আছে, যারা তাঁদের নির্বুদ্ধিতার জন্য মারা যাবে, এক দুর্দশাগ্রস্ত লতা থেকে পাতাগুলো ঝরে পড়ে যাচ্ছে এই কারনে? আমি এই ধরনের কথা আগে কখনো শুনি নি। না, আমি আপনার বোকা নির্জনবাসী – নির্বোধ ব্যক্তির মডেলের পোজ দিতে পারব না। এই ধরনের বোকাটে কারবার কেন আপনি তাঁর মাথায় আসতে দিলেন? আহ, বেচারা ছোট্ট মিস জনসি।”
“সে এখন খুবই অসুস্থ ও দুর্বল,” সিউ বলল, “ এবং জ্বর তাঁর মনটাকে অসুস্থ করে দিয়েছে, আজব সব অবাস্তব কল্পনায় তাঁর মন ভরে উঠেছে। খুব ভালো, বেহরম্যান সাহেব, যদি আপনি আমার জন্য পোজ দিতে না চান, আপনাকে প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমার মনে হয় আপনি একজন কুৎসিত বুড়ো – গল্পগুজবপ্রিয় বুড়ো ফচকে।”
“আপনিও আর দশটা মেয়ে মানুষের মতো!” চেঁচিয়ে উঠল বেহরম্যান। “কে বলল আমি পোজ দিব না? চলুন। আমি আপনার সাথে যাচ্ছি। আধা ঘন্টা ধরে আপনাকে আমি বলার চেষ্টা করছি, পোজ দিতে আমি প্রস্তুত। হায় ইশ্বর! এমন কোনো জায়গা থাকতে পারে না যেখানে মিস জনসির মতো একজন ভালো মানুষকে অসুস্থ হয়ে পড়তে হবে। একদিন আমি আমার শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মটি আঁকব, এবং একদিন আমাদের সবাইকে চলে যেতে হবে। হায় ইশ্বর! হ্যাঁ।”
তাঁরা উপরের তলায় যখন গেল, জনসি তখন ঘুমোচ্ছিল। সিউ জানালার চৌকাঠ পর্যন্ত পর্দা টেনে দিয়ে বেহরম্যানকে ইশারা করে অন্য রুমে যেতে বলল। সেখানে তাঁরা ভয়ের সাথে জানালার বাইরে উকি দিয়ে আইভি লতাটিকে দেখল। এরপর তাঁরা নিশ্চুপ থেকে কিছু সময়ের জন্য একে অপরের দিকে তাঁকালো। তুষারপাতসহ অবিরামভাবে শৈত্য বৃষ্টি পড়ছিল। বেহরম্যান তাঁর পুরনো নীল শার্টটি গায়ে চড়িয়ে, উল্টে রাখা কেটলির উপর অবিচলিতভাবে নির্জনবাসী খনি – শ্রমিকের মত বসে পড়ল।
পর দিন সকালে সিউ যখন তাঁর এক ঘন্টার ঘুম থেকে জেগে উঠল, জনসিকে দেখতে পেল মলিন, পুরোপুরি খোলা চোখ নিয়ে এক দৃষ্টিতে টেনে দেয়া সবুজ পর্দাটার দিকে তাঁকিয়ে আছে।
“এটাকে উপরে টেনে দাও; আমি দেখতে চাই,” জনসি ফিসফিসিয়ে নির্দেশ দিল।
সিউ ক্লান্তভাবে নির্দেশ পালন করলেন।
কিন্তু, দেখুন! সারা রাত ধরে তীব্র বৃষ্টিপাত ও আকষ্মিক প্রবল ঝড়ো হাওয়া সহ্য করার পরেও, ইটের দেয়ালে একটা আইভি পাতা তখনো টিকে আছে। এটা ছিল লতাটির শেষ পাতা। কান্ডের কাছে এটি এখনো গাঢ় সবুজ; মলিন ও ক্ষয়ে যাওয়া খাঁজ কাটা হলুদ প্রান্ত নিয়েও মাটি থেকে কুড়ি ফুট উপরে এক প্রশাখার সাথে চমৎকারভাবে ঝুলে আছে।
“এটাই শেষ পাতা,” জনসি বলল, “আমি ভেবে ছিলাম, এটা নিশ্চিতভাবেই কাল রাতে পড়ে গেছে। আমি বাতাসের শব্দ শুনেছিলাম। এটা আজকে পড়ে যাবে, এবং তখন আমিও মরে যাবো।”
“সোনা, সোনা!” সিউ তাঁর মলিন মুখখানা বালিশে চেপে বলল, “যদি তুমি তোমার কথা ভাবতে না চাও, তবে আমার কথা ভাবো। তাহলে আমি কি করব?”
কিন্তু জনসি কোনো উত্তর দিল না। একটি আত্না যখন তাঁর রহস্যময়, দূরের যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নেয়, তখন এটি হয়ে দাঁড়ায় পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি একাকী আর দুঃখকাতর কোনো অস্তিত্ব। অবাস্তব কল্পনা তাঁর মাঝে এত প্রবলভাবে ভর করে যেন সব ধরনের বন্ধন যা তাঁকে বেঁধে ছিল বন্ধুত্বের মাঝে, পৃথিবীর সাথে, এক এক করে মুক্ত হয়ে যায়।
দিন পেরিয়ে গেল, এমনকি গোধূলির সময়ও তাঁরা নিঃসঙ্গ আইভি পাতাটিকে দেয়ালের উপর তার কান্ডের সাথে দৃঢ়ভাবে এঁটে থাকলে দেখল। এবং এরপর, রাত নেমে এলে উত্তরীয় হাওয়া আবার বইতে শুরু করল, জানালার উপর বৃষ্টি আছড়ে পড়ল সেদিনও এবং ছাদের সামনের দিকের নিচু অংশ দিয়ে টিপটিপ করে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পড়ল।
যখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল, হৃদয়হীনা জনসি পর্দাটিকে উপরে টেনে দিতে আদেশ দিল।
আইভি পাতাটি তখনো সেখানে ছিল।
জনসি বিছানায় শুয়ে দীর্ঘ সময় ধরে এটার দিকে তাঁকিয়ে থাকল। এরপর সে সিউকে ডাকল, সিউ তখন গ্যাসের চুল্লীর উপর রাখা চিকেন স্যুপকে চামচ দিয়ে নেড়ে দিচ্ছিল।
“আমি খারাপ মেয়ে হয়ে গেছি, সিউডি,” জনসি বলল, “কোনো একটা কারনে শেষ পাতাটি সেখানে থেকে গিয়ে আমাকে দেখাচ্ছে কতটা মন্দ আমি। মরতে চাওয়াটা পাপ। তুমি আমাকে অল্প একটু স্যুপ এনে দাও, আর কিছু পরিমান দুধের সাথে অল্প একটু পোর্ট ওয়াইন, আর – না; প্রথমে তুমি আমার জন্য একটা হাত-আয়না নিয়ে আসো, এর পর আমার কিছু বালিশ জড়ো করো, আমি এর উপর বসে তোমার রান্না করা দেখব।”
এবং ঘন্টাখানেক পর সে বললঃ “সিউডি, আশা করি এক দিন আমি নেপলস উপসাগরকে আঁকতে পাড়ব।”
ডাক্তার বিকেলের দিকে এল, এবং সিউ ওজর দেখিয়ে ডাক্তারের সাথে বারান্দার দিকে গেল।
“এমনকি সুযোগ পেলে,” ডাক্তার সিউয়ের সরু হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ঝাকাতে ঝাকাতে বলল, “ভালো সেবা দিয়ে আপনি জয়ী হবেন।” “এখন আমাকে নীচতলার আরেকজন রোগীকে অবশ্যই দেখতে যেতে হবে। বেহরম্যান,তাঁর নাম – এক প্রকার চিত্রশিল্পী বলতে পারেন, আমি বিশ্বাস করি, তাঁরও নিউমোনিয়া হয়েছে। সে একজন বুড়ো, দুর্বল মানুষ, এবং আক্রমণটাও খুব মারাত্নক। তাঁর বেঁচে থাকার কোনো আশা নেই; তবুও সে আজ হাসপাতালে গিয়েছে আরো অধিক আরামবোধ করার জন্য।”
পরের দিন ডাক্তার সিউকে বলল, “সে এখন বিপদমুক্ত। আপনি জিতে গেছেন। পুষ্টিকর খাবার আর যত্ন – এখন শুধু এইটুকুই যথেষ্ট।”
জনসি যে বিছানায় শুয়েছিল সিউ সেই বিকেলে সেখানে এল, একটি গাঢ় নীল এবং ব্যবহারের একেবারেই অযোগ্য উলের তৈরী কাঁধের  স্কার্ফ মনের আশ মিটিয়ে সেলাই করতে লাগল এবং অন্যহাত দিয়ে জনসি, তাঁর বালিশ এবং চারপাশে বুলাতে লাগল।
“আমার সাদা ইঁদুর, তোমাকে কিছু বলার আছে আমার,” সিউ বলল, “বেহরম্যান সাহেব আজ হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় মারা গেছে। সে মাত্র দুই দিন অসুস্থ ছিল। প্রথম দিন সকালে দাঁড়োয়ানেরা তাঁকে নীচতলায় তাঁর রুমে অসহায়ভাবে ব্যাথায় কাঁতারানো অবস্থায় পেয়েছিল। তাঁর জুতো ও কাপর–চোপড় ছিল ভেজা এবং বরফ শীতল। তারা কল্পনাও করতে পারে নি ঐ ভয়ঙ্কর রাতে সে কোথায় ছিল। এরপর তারা একটি লণ্ঠন দেখতে পেল, সেটা তখনো জ্বলছিল, এবং আর একটি মই যেটি এখান থেকে টেনে নেওয়া হয়েছিল, আর কিছু ইতস্তত ছড়ানো ব্রাশ এবং একটি প্যালেট (চিত্রশিল্পীদের রঙ গোলা ও মেশানোর জন্য ব্যবহৃত বোর্ডবিশেষ) যার উপর সবুজ এবং হলুদ রঙ মেশানো হয়েছিল – জানালার বাইরের দিকে দেয়ালের উপর শেষ আইভি পাতাটার দিকে একটু তাঁকাও, সোনা। তুমি কি একটুও বিস্ময়াভিভূত হও না কেন বাতাস বয়ে গেলে এটি দোলে না বা নড়াচড়া করে না? ওহ সোনা! এটাই বেহরম্যানের শ্রেষ্ঠচিত্রকর্ম – শেষ পাতাটি পড়ে যাবার পর সেদিন রাতে সেখানে সে এটি এঁকেছে।”