সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বার্ড ফ্লু এর মত ছড়িয়ে পড়েছে ইভ টিজিং এর ভয়াবহতা। কিন্তু এখন ক্রমেই সারাদেশে মহামারীর রূপ নিতে যাচ্ছে ইভ টিজিং। সম্ভবত গড় বছর মহিলা এবং শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে একটি মুঠোবার্তা এসেছিল আমার মুঠোফোনে (হয়ত আরো অনেকেই মেসেজটি পেয়ে থাকবেন)। মুঠোবার্তায় লেখা ছিলঃ ইভ টিজিং এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন।................
বলতে পারবেন মেসেজটি পাওয়ার পর সোচ্চার হতে পেরেছিলেন কে.....
কেউ আমার মত কিভাবে সোচ্চার হবেন তা প্রথমে বুঝতে পারেন নি, অথবা ভয় পেয়েছিলেন। ভয় পাওয়া স্বাভাবিক কারন বর্তমানে ইভ টিজিং এ বাধা দিতে গেলে যে প্রাণ দিতেও হয়....
ইভ টিজিং কি?
ইভ টিজিং প্রকাশ্যে যৌন হয়রানি পথেঘাটে উত্যক্ত করা বা পুরুষ দ্বারা নারীনিগ্রহ নির্দেশক একটি কাব্যিক শব্দ যা মূলত ভারত, পাকিস্থান, বাংলাদেশ ও নেপালে ব্যবহৃত হয়। ইভ দিয়ে পৌরানিক আদিমাতা হাওয়া অর্থে সমগ্র নারীজাতিকে বোঝানো হয়। এটি তারুণ্যে সংঘটিত একধরনের অপরাধ। এটি এক ধরনের যৌন আগ্রাসন যার মধ্যে রয়েছে যৌন ইঙ্গিতবাহী মন্তব্য, প্রকাশ্যে অযাচিত স্পর্শ, শিস দেওয়া বা শরীরের সংবেদনশীল অংশে হস্তক্ষেপ। কখনো কখনো একে নিছক রসিকতা গণ্য করা হয় যা অপরাধীকে দায় এড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।. অনেক নারীবাদী সংগঠন আরো উপযুক্ত শব্দ দিয়ে ইভ টিজিংকে প্রতিস্থাপনের দাবি জানিয়েছেন। তাদের মতে ইভ শব্দের ব্যবহার নারীর আবেদনময়তাকে নির্দেশ করে যে কারণে উত্ত্যক্ত হওয়ার দোষ নারীর উপর বর্তায় আর পুরুষের আচরণ আগ্রাসনের পরিবর্তে স্বাভাবিক হিসেবে ছাড় পায়। ইভ টিজাররা নানান সৃজনশীল কৌশলে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে থাকে। ফলে এ অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন। এমনকি অনেক নারীবাদী একে "ছোটখাটো ধর্ষণ" বলে আখ্যায়িত করেছেন। কেউ কেউ ইভ টিজিং থেকে রেহাই পেতে নারীদের রক্ষণশীল পোশাক আশাক পরতে উৎসাহিত করেন। তবে রক্ষণশীল পোশাক পরিহিত নারীরাও ইভ টিজিং-এর শিকার হচ্ছেন এমন উদাহরণও অগণিত।
নারীর উপর ইভ টিজিং এর প্রভাবঃ
ইভ টিজিং নারীর জন্য বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা। নারীকে মানসিকভাবে দূর্বল করে দেয়। কিছু কোমলমতি মেয়েরা এতই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে যে তারা আত্মাহুতি দিতেও পিছপা হচ্ছে না।
এর আরেকটি ক্ষতিকর প্রভাব হল এটা বাল্যবিবাহের হার বাড়িয়ে দেয়। বাবা-মা ভাবেন তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দিলে ইভ টিজিং এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। তাছাড়া বাবা মা বাধ্য হয়ে মেয়ের স্কুল-কলেজে যাওয়াও বন্ধ করে দিচ্ছেন।
ইভ টিজিং এর শিকার নারীরা অসহায়ত্ব অনুভব করেন, সাথে থাকে ক্রোধ, হতাশা এবং অন্যের প্রতি বিশ্বাসের অভাব। পরিনামে ডেকে আনে অকালমৃত্যু।
ইভ টিজিং প্রতিরোধ
ইভ টিজিং প্রতিরোধ মোটেই কঠিন কিছু নয়। তবে এতে নারীর ভূমিকা নগন্য; পুরুষের ভূমিকাই আসল। কেননা আমদের মনে রাখতে হবে ইভ টিজিংয়ে নারী কেবলমাত্র এর শিকার (পুরুষ কর্তৃক)। প্রয়োজনীয় শিক্ষা এবং নারীর প্রতি যথোপযুক্ত সন্মান প্রদর্শন করেই ইভ টিজিং প্রায় সম্পূর্ণ প্রতিরোধ করা যায়।
তবে এর পাশাপাশি নারীদেরও কিছু কিছু ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিত, যেমনঃ অন্ধকারাচ্ছন্ন গলি বা একাকী রাস্তা এড়িয়ে চলা, জনাকীর্ণ স্থানে শালীন পোশাক পড়া, ইভ টিজার কর্তৃক আক্রান্ত হলে সাহস না হারিয়ে মোকাবেলা কিংবা জোরে চিৎকার করা, সম্ভব হলে পুরুষ সঙ্গীর সাথে চলাফেরা করা ইত্যাদি।
তাছাড়া আইনের সুষ্টু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে করে কোন ইভটিজার্ আইনের হাত থেকে রক্ষা না পাই। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুলিশকে দক্ষতার ও সততার পরিচয় দিতে হবে।
ইভ টিজিং প্রতিরোধের বড় শিক্ষা পরিবার থেকে আসবে। মেয়েরা ঠিকমতো স্কুল-কলেজে যেতে পারছে না, ঝড়ে পড়ছে, অভিভাবকরা মেয়েদের বাল্য বিবাহ দিতে বাধ্য হচ্ছে, মেয়ে ও তাদের পরিবারের ওপর চাপ পড়ছে যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। সরকারকে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধই এটা নিরাময়ে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করতে হবে। মেয়েদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গীকে ইতিবাচক করতে হবে। মেয়েদের অধিকার ও মর্যাদা প্রদান করতে হবে। সমাজের গণ্যমান্য লোকজনকে নিয়ে প্রতিটি স্কুল-কলেজে প্রতিরোধ কমিটি গঠনের মাধ্যমে ইভ টিজিং কিছুটা হলেও প্রতিরোধ সম্ভব। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়সমূহের সহযোগিতায় দ্রুত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০৩ এর ধারা-১০ এর সংশোধন করে ইভ টিজারদের জন্য দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক ৫০৯ ধারাকে মোবাইল কোর্টে সংযুক্ত করায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানায় ।
শেষ কথাঃ
ইভ টিজিং একটি সামাজিক ব্যাধি যা আমরা সহজেই দূর করতে পারি আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন করে। আইনের পাশাপাশি শিক্ষা এবং নারীদের প্রতি সন্মান ইভ টিজিং প্রতিরোধের মূল সহায়ক। কিছু কিছু এনজিও ইভ টিজিং প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা রাখছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন