সোমবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৮

ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মীবাঈ - এক তেজস্বী রাণীর জন্মদিনে শ্রদ্ধা !



প্রাচীন যুগে ভারতীয় উপমহাদেশে নারীরা ছিল শিক্ষা, দীক্ষা, চেতনা মননে এগিয়ে। সে সময় ছেলেদের পাশাপাশি তাদের সমান সুযোগ ছিল সকল ক্ষেত্রে। কিন্তু এই উপমহাদেশে বিদেশি শাসকদের কাল থেকে শুরু হল অন্ধকার যুগ। প্রতি ক্ষেত্রে নারী জাগরনে আসতে লাগল বাধা। নারীদের বাধ্য করা হয় অন্তঃপুরে থাকতে। বার কারনে সমাজের সাথে সাথে নারীরাও পিছিয়ে পড়ল।

কিন্তু তার মাঝেও আঠার শতকে আমারা দেথলাম এক মহীয়ষী নারীকে, যিনি সমস্ত প্রথাকে ভেঙ্গেচুরে স্থাপন করেছেন দেশ প্রেমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। যা আমাদের কে মনে করিয়ে দেয় সেই প্রাচীন নারীদের কথা। 


যখন বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের মানুষের প্রথম সচেতন অভ্যুত্থানের আর এক নাম সিপাহি বিপ্লব। এই সিপাহি বিপ্লবের ইতিহাসের সঙ্গে যার নাম। উল্লেখযোগ্য তিনি হলেন ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মীবাঈ। লক্ষ্মী বাঈ ১৮৩৫ সালের ১৯ নভেম্বর তার জন্ম বারানসীর কাশীতে মহারাষ্ট্রের ব্রাহ্মণ পরিবারে। তার প্রকৃত নাম মণি কর্ণিকা এবং ডাক নাম মনু। তার পিতা মরোপান্ত তাম্বে এবং মাতা ভগীরথি বাঈ তাম্বে। বিথুরের পেশোয়া আদালতে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন তার পিতা। সেখানে পরবর্তীতে নিজ কন্যাকে মনের মতো করে গড়ে তুলতে থাকেন মরুপান্ত তাম্বে। বাড়িতেই তার পড়াশোনা। মাত্র চার বছর বয়সে মাকে হারান লক্ষ্মীবাঈ। শৈশবে তার বয়সী মেয়েদের চেয়ে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। বাবা কোর্টের কাজ-কর্মে জড়িত থাকায় রাণী লক্ষ্মী বাঈ ঐ সময়ের অধিকাংশ নারীদের তুলনায় অধিক স্বাধীনতা ভোগ করতে পেরেছিলেন। আত্মরক্ষামূলক শিক্ষালাভের পাশাপাশি ঘোড়া চালনা, আর্চারী শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন তিনি। এছাড়াও তিনি তার বান্ধবীদেরকে নিয়ে নিজস্ব একটি বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। 

১৮৪২ সালে ঝাঁসীর মহারাজা গঙ্গাধর রাও নিওয়াকরের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন লক্ষ্মী বাঈ। এভাবেই তিনি ঝাঁসীর রাণী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। বিয়ের পরই তাঁর নতুন নামকরণ হয় লক্ষ্মী বাঈ। মিষ্টি-মধুর বিবাহিত জীবনে মায়ের কোল আলো করে ১৮৫১ সালে তাদের প্রথম পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। যার নাম রাখা হয় দামোদর রাও। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে নিষ্ঠুর ভাগ্যের কাছে লক্ষ্মী বাঈকে বারবার পরাজিত হতে হয়েছে করুণভাবে। মায়ের কোল খালি করে মাত্র চার দিনের মাথায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে তাঁর পুত্রসন্তান। পুত্র হারাবার শোক ভোলার জন্যেই পরবর্তি সময়ে গঙ্গাধর রাও-এর চাচাতো ভাইয়ের ছেলে আনন্দ রাও-কে দত্তক নেন এই দম্পতি। যার নাম বদলে রাখা হয় দামোদর রাও। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, পুত্র হারাবার মাত্র দু’বছরের মাথায়  ১৮৫৩ সালের ২১ নভেম্বর স্বামী গঙ্গাধর রাওকেও হারান লক্ষ্মী বাঈ। আনন্দ রাওকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করার সময়ে রাজা গঙ্গাধর তৎকালিন সময়ের ব্রিটিশ পলিটিক্যাল অফিসারেকে একটি চিঠি পাঠান যে , তাঁর মৃত্যুর পর দত্তককৃত সন্তানকে যেন পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে বড় করে তোলা হয় এবং ঝাঁসির সকল দায়দায়িত্ব তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মী বাঈ-এর কাছে সমর্পণ করা হয়। কিন্তু ব্রিটিশ-ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর-জেনারেল লর্ড ডালহৌসী  Doctrine of Lapse প্রয়োগ করেন এবং লক্ষ্মী বাঈকে তাঁর এলাকা ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দেন। 

অন্যায়-অবিচার আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এক হিন্দু নারীর অসাধারণ প্রতীক হয়ে আছেন ঐতিহাসিক নারী চরিত্র ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ। সর্বসাধারণের কাছে তিনি ঝাঁসীর রাণী বা ঝাঁসী কি রাণী হিসেবেও ব্যাপকভাবে পরিচিত। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতবর্ষের ইতিহাসে তিনিই ছিলেন মোটামুটি প্রথম সফল নারী যোদ্ধা। যত দিন মানুষ জোর করে বলবে "রাণী মরগেই ন হৌউনী" ততদিন রাণীর মৃত্যূ নেই। 

১৭ জুন, ১৮৫৮ সালে ফুল বাগ এলাকার কাছাকাছি কোটাহ-কি সেরাইয়ে রাজকীয় বাহিনীর সাথে যুদ্ধ চালিয়ে শহীদ হন রাণী। পরবর্তীতে আরো তিনদিন পর ব্রিটিশ সেনাদল গোয়ালিয়র দখল করে। ১৮৫৮ সালের ১৭জুন তার মরদেহ ভস্ম হয়ে গিয়েছে সত্য। তবু তিনি অমর। "অমর হ্যায় ঝাঁসী কি রাণী"। যিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কখনোই মাথা নত করেন নি। যুদ্ধ করে, নিজের শক্ত হাতে প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করে তবেই শহীদ হয়েছেন তিনি। ইতিহাসের পাতায় আজীবনের জন্য স্থান করে নিয়েছেন এই রাণী। যার মৃত্যূর পর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের পক্ষে জেনারেল হিউজ রোজ তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে, “রাণী তার সহজাত সৌন্দর্য্য, চতুরতা এবং অসাধারণ অধ্যবসায়ের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। এছাড়াও, তিনি বিদ্রোহী সকল নেতা-নেত্রীর তুলনায় সবচেয়ে বিপজ্জনক ছিলেন।”

আজ সেই বীর নারী যোদ্ধার জন্মবার্ষিকী। তার এই জন্মবার্ষিকীতে তার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

11/19/2018

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন