“আপনারা ফিরে যান্। আমি বিষ খেয়েছি। চললাম্ যেখানে আছে শহীদ র্নিমলদা, ভোলা, রামকৃষ্ণদা ও আর সবাই- বিদায়।”
এইভাবে ১৯৩২ সালে আজকের এই দিনে চলে গেলেন বাঙলার অগ্নিযুগের প্রথম নারী শহীদ প্রীতিলতা।
তাঁর পুরো নাম ছিল প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার । জন্মগ্রহন করে ছিলেন ১৯১১ সালের ৫ই মে মঙ্গলবার চট্টগ্রামের ধলঘাট গ্রামে।পিতা ছিলেন চট্টগ্রাম পৌরসভার প্রধার করণিক জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার এবং মাতা প্রতিভাদেবী।তাঁদের ছয় সন্তানঃ মধুসূদন, প্রীতিলতা, কনকলতা, শান্তিলতা, আশালতা ও সন্তোষ। তাঁদের পরিবারের আগের পদবী ছিল দাশগুপ্ত। পরিবারের কোন এক পূর্বপুরুষ সম্ম্রাট আকবরের আমলে “ওয়াদ্দেদার” উপাধি পেয়েছিলেন। ছোট বেলায় বাবার মৃত্যুর পর জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার তাঁর পৈত্রিক বাড়ি ডেঙ্গাপাড়া সপরিবারে ত্যাগ করেন। তিনি পটিয়া থানার ধলঘাট গ্রামে মামার বাড়িতে বড় হয়েছেন। ধলঘাটের সেই বাড়িতে প্রীতিলতার জন্ম হয়। ছোটবেলা থেকে আদর করে মা প্রতিভাদেবী তাঁকে “রাণী” ডাকতেন।
ডাঃ খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় দিয়ে প্রীতিলতার শিক্ষা জীবনের অভিষেক হয়।১৯১৮ সালে তিনি এই স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। পড়াশুনায় ভাল ছিল বলে স্কুলের সবাই তাঁকে খুব ভাল বাসত। শিশুবয়সে প্রীতিলতার স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক ঊষাদি তাঁকে পুরুষের বেশে ঝাঁসীর রানী লক্ষীবাঈ এর জীবনী পড়তে দিয়ে ছিলেন। ঘোড়ায় উপবিষ্ট, উন্মুক্ত তরবরি হাতে নিয়ে, পুরূষ বেশে ইংরেজ সৈন্যদের সাথে লড়াইয়ের ইতিহাস ও দৃপ্ত আহ্ববান ‘মেরী ঝাঁসী নেহী দুঙ্গী’ প্রতিলতাকে মারাত্বক ভাবে আকৃষ্ট করে। ভাগ্যের কি পরিহাস তা ডাক নাও ছিল ‘রানী’। তাই নিজেকে লক্ষ্মীবাই-এর মত বিপ্লবিনী হিসেবে তৈরী করথে চেয়েছিল।স্কুলে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন ছিলেন কল্পনা দত্ত তাঁদের স্বপ্নের কথা লিখেছেন " সেই সময়ে ঝাঁসীর রানী আমাদের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। নিজেদেরকে আমরা অকুতোভয় বিপ্লবী হিসাবে দেখা শুরু করলাম।" ১৯২৮ সালে তিনি কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর বন্ধের সময় তিনি নাটক লিখেন এবং মেয়েরা সবাই মিলে সে নাটক চৌকি দিয়ে তৈরী মঞ্চে পরিবেশন করেন। আই.এ. পড়ার জন্য তিনি ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩০ সালে আই.এ. পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সবার মধ্যে পঞ্চম স্থান লাভ করে। প্রতিলতা ইডেনে পড়ার সময় চট্টগ্রামের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বর্পুণ পরিবর্তন আসে। র্সূযসেন ও চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা প্রত্যক্ষভাবে কংগ্রেসে যোগদানের মাধ্যমে চরমপন্থী আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হতে চাইলেন। তাঁরা গোপনে আইরিশ রিপাব্লিকান আর্মির মত ইন্ডিয়ান রিপাব্লিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখা গঠন করে।
পরবর্তীতে কলকাতার বেথুন কলেজ়ে বি এ পড়তে যান। বেথুন কলেজে মেয়েদের সাথে তাঁর আন্তরিক সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল। প্রীতিলতার বি.এ. তে অন্যতম বিষয় ছিল দর্শন। দর্শনের পরীক্ষায় তিনি ক্লাসে সবার চাইতে ভাল ফলাফল লাভ করতেন। এই বিষয়ে তিনি অনার্স করতে চেয়েছিলেন কিন্তু বিপ্পবের সাথে যুক্ত হবার তীব্র আকাঙ্ক্ষার কারনে অনার্স পরীক্ষা তাঁর আর দেয়া হয়নি। ১৯৩২ সালে ডিসটিংশান নিয়ে তিনি বি.এ. পাশ করেন। কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় কৃতিত্বের সাথে স্নাতক পাস করলেও তিনি এবং তাঁর সঙ্গী বীণা দাসগুপ্তের পরীক্ষার ফল স্থগিত রাখা হয়।
প্রীতিলতা মনে বিপ্লবী চেতনার বিকাশ ঘটে কৈশোরে। চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা তখন মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন শেষে সক্রিয় হচ্ছিলেন। তার মধ্যে ১৯২৩-এর ১৩ ডিসেম্বর টাইগার পাস এর মোড়ে সূর্য সেনের বিপ্লবী সংগঠনের সদস্যরা প্রকাশ্য দিবালোকে সরকারী কর্মচারীদের বেতন বাবদ নিয়ে যাওয়া ১৭,০০০ টাকা ছিনতাই করে। এ ছিনতাইয়ের প্রায় দুই সপ্তাহ পর গোপন বৈঠক চলাকালীন অবস্থায় বিপ্লবীদের আস্তানায় হানা দিলে পুলিশের সাথে যুদ্ধের পর গ্রেফতার হন সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী। তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় রেলওয়ে ডাকাতি মামলা। এই ঘটনা কিশোরী প্রীতিলতাকে চিন্তিত করে তোলে। স্কুলের প্রিয় শিক্ষক ঊষাদির সাথে আলোচনার মাধ্যমে এই মামলার ব্যাপারে বিস্তারিত ভাবে অনেক কিছুই জানতে পারেন তিনি। ১৯২৪ সালে বেঙ্গল অর্ডিনান্স নামে এক জরুরি আইনে বিপ্লবীদের বিনাবিচারে আটক করা শুরু হয়। চট্টগ্রামের বিপ্লবীদলের অনেক নেতা ও সদস্য এই আইনে আটক হয়েছিল। তখন বিপ্লবী সংগঠনের ছাত্র আর যুবকদেরকে অস্ত্রশস্ত্র, সাইকেল ও বইপত্র গোপনে রাখার ব্যবস্থা করতে হত। সরকার বিপ্লবীদের প্রকাশনা সমুহ বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। প্রীতিলতার নিকট-আত্মীয় পূর্ণেন্দু দস্তিদার তখন বিপ্লবী দলের কর্মী। তিনি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত কিছু গোপন বই প্রীতিলতার কাছে রাখেন। তখন তিনি দশম শ্রেনীর ছাত্রী। লুকিয়ে লুকিয়ে তিনি সে সব বইগুলো পড়েন । এই সমস্ত গ্রন্থ প্রীতিলতাকে বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে। প্রীতিলতা দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদারের কাছে বিপ্লবী সংগঠনে যোগদান করার গভীর ইচ্ছার কথা বলেন। কিন্তু তখনো পর্যন্ত বিপ্লবীদলে মহিলা সদস্য গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি নিকট আত্মীয় ছাড়া অন্য কোন মেয়েদের সাথে মেলামেশা করাও বিপ্লবীদের জন্য নিষেধ ছিলো।
যদিও প্রীতিলতা ইডেন কলেজের শিক্ষিকা নীলিমাদি ও লীলা রায়ের অনুপ্রেরণায় দীপালী সঙ্ঘে যোগ দিয়ে লাঠিখেলা, ছোরাখেলা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষন গ্রহণ করেন। যাতে করে তিনি নিজেকে মহান মাস্টারদার একজন উপযুক্ত কমরেড হিসাবে গডে তুলতে পারেন। তিনি র্সূযসেনকে তাঁর হৃদয়ের মধ্যে শ্রদ্ধার আসন দিয়ে ছিলেন। তিনি বিপ্লবিদের সহায়তা নয়, দেশের জন্য নিজের জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। তাই র্পুণদার কথায় তিনি প্রীতিলতাকে দলে নিলে ও কোন গুরূত্বপূর্ণ দ্বায়িত্ব দেননি বরং র্পূণদাকে কঠোর গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য বললেন। মেয়েরা তার ইচ্ছা অনুযায়ী অনেক অত্যাচার সহ্য করে, অলংকারাদি দিয়ে সাহার্য্য, অন্যান্য মেয়েদের বিভিন্ন বই পড়িয়ে বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ করা ও গোপনে যোগাযোগ রেথে চট্টগ্রাম দলকে সহায়তা করা।
কিন্তু প্রীতিলতার এধরনের ২য় সারির কাজগুলো ভাল লাগতনা। তাঁর ইচ্ছে হল মাষ্টারদার সাথে দেখা করে সরাসরি বিপ্লবে অংশ নেওয়া।
এর মধ্যে প্রীতিলতা সান্নিধ্য পাই রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের। যিনি সে সময়ের বাংলার ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ টি জে ক্রেগ কে হত্যার দ্বায়িত্ব পান। কিন্তু ভুল করে তাঁরা মিঃ ক্রেগের পরিবর্তে চাঁদপুরের এস ডি ও তারিণী মুখার্জিকে হত্যা করেন। সেদিনেই পুলিশ বোমা আর রিভলবার সহ রামকৃষ্ণ বিশ্বাসকে গ্রেপ্তার করে। তারিণী মুখার্জি হত্যা মামলার রায়ে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। মনোরঞ্জন রায় প্রীতিলতার কাছে লেখা এক চিঠিতে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে দেখা করার চেষ্টা করতে অনুরোধ করেন। সে অনুযায়ী প্রীতিলতা মৃত্যুপ্রতীক্ষারত রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে দেখা করার জন্য আলিপুর জেল কর্তৃপক্ষের কাছে “অমিতা দাস” ছদ্মনামে “কাজিন” পরিচয় দিয়ে দরখাস্ত করেন। জেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেয়ে তিনি প্রায় চল্লিশবার রামকৃষ্ণের সাথে দেখা করেন। ১৯৩১ সালের ৪ আগস্ট রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসী হয়। এই ঘটনা প্রীতিলতার জীবনে এক আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে। রামকৃষ্ণদার ফাঁসীর পর বিপ্লবী কর্মকান্ডে সরাসরি যুক্ত হবার আকাঙ্ক্ষা তাঁর অনেক বেড়ে যায়।
ইতিপূর্বে প্রীতিলতার সাথে পরিচয় হয় কল্পনা দত্তের। প্রীতিলতা কলকাতা থেকে আসার এক বছর আগে থেকেই কল্পনা দত্ত বেথুন কলেজ থেকে বদলী হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে বি এস সি ক্লাসে ভর্তি হন। ফলে প্রীতিলতার আগেই কল্পনা দত্তের সাথে মাষ্টারদার দেখা হয়। কল্পনার কাছে রিভলবার, বোমা, বৈদ্যুতিক তার, ছোরা প্রভৃতি ছিল। কল্পার সাথে মাষ্টারদার বেশ কয়েকবার দেখা হয়, প্রয়োজনে তিনি নিজেই তাঁর সঙ্গে সহজে সাক্ষাৎ করতেন।
বিপ্লবী মাষ্টারদা সূর্য সেনের সাথে সাক্ষাতের আগ্রহের কথা প্রীতিলতা কল্পনা দত্তকে বলেন। প্রীতিলতার প্রবল আগ্রহের কারনেই কল্পনা দত্ত একদিন রাতে গ্রামের এক ছোট্ট কুটিরে তাঁর সাথে নির্মল সেনের পরিচয় করিয়ে দেন।
১৯৩২ সালের মে মাসের গোড়ার দিকে ঐ সাক্ষাতে নির্মল সেন প্রীতিলতাকে জীবনে দুটি সবচেয়ে প্রিয় বস্তু নিয়ে প্রশ্ন করেতার মনোজগতের পরীক্ষা করেছিলেন। পরিবারের প্রতি কেমন টান আছে তা জানতে চাইলেন। জবাবে তিনি বলেন “টান আছে। কিন্তু duty to family-কে duty to country-র কাছে বলি দিতে পারব”
অত্যান্ত যত্ন সহকারে র্নিমল সেন প্রীতিলতাকে রিভেলবার চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। মেশিনের ব্যবহার সর্ম্পকে তাঁর কোন ধারনা ছিলনা। রিভলবারের বিভিন্ন অংশকে কি বলে, কেমন করে গুলি ভরতে হয়, সবকিছু ধৈর্য্ ধরে শিখিয়ে ছিলেন র্নিমলদা। আত্মরক্ষার জন্য প্রীতিলতাকে যুযুৎসুও শিখিয়ে ছিলেন র্নিমলদা।গভীর রাতে বিপ্লবীদের টার্গেট প্র্যাকটিস-এর ব্যাবস্থা করা হল। পলাতক জীবনে নারী পুরুষের সম্মিলিত অভিযান এক দারূণ ঘটনা।পাঁচজন বিপ্লবীর সাথে, নির্মলদার নেতৃত্বে, গহীন বনে প্রশিক্ষনে যাওয়াটা প্রীতিলতার জীবনে এক স্মরনীয় ঘটনা।
যুব বিদ্রোহের পর বিশৃঙ্খল হয়ে পড়া সংগঠনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজে মাষ্টারদা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার কারনে প্রীতিলতার সাথে সে রাতে তাঁর দেখা হয়নি।
১৯৩২ সালে ধলঘাটের ঘটনা প্রীতিলতার জীবনে এক র্পূণ বৈপ্লবিক পর্রিবতন আনে।এখানেই মাষ্টারদার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল প্রীতিলতার। ধলঘাটের যে টিনের ছাউনি দেওয়া মাটির বাড়ীতে বিপ্লবীরা আশ্রয় নিয়েছিল সে বাড়ীটি ছিল সাবিত্রি দেবী নামে এক বিধবার। তিনি ও তার একমাত্র পুত্র রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী সামান্য সম্পত্তি নিয়ে এই বাড়ীতে বাস করতেন। তাঁর বিবাহিত কণ্যা স্নেহলতা মাঝে মাঝে এবাড়ীতে আসতেন। জালালাবাদ যুদ্ধের পর তিনি চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুন্টনের আত্মগোপনকারী বিপ্লবীদের এই বাড়ীতে তিনি আশ্রয় দিয়ে ছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন র্সূয সেন, র্নিমল সেন, অর্পূব সেন ও প্রিতিলতা। ১৯৩২ সালের ১২ জুন তুমুল ঝড় বৃষ্টির দিনে মাষ্টারদার পাঠানো এক লোক প্রীতিলতাকে আশ্রমে নিয়ে আসেন। বাড়িতে প্রীতিলতা তাঁর মাকে সীতাকুন্ড যাবার কথা বলেন। ধলঘাটের এই বাড়ীতে প্রথম র্সূয সেনের সাথে দেখা হয় প্রীতিলতার। রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে তার দেখা হও্য়ার ইতিবৃত্ত, রামকৃষ্ণের প্রতি তার শ্রদ্ধা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রীতিলতা প্রায় দুই ঘন্টার মতো মাষ্টারদার সাথে কথা বলেন। মাষ্টারদা আরো লিখেছেন “তার action করার আগ্রহ সে পরিষ্কার ভাবেই জানাল। বসে বসে যে মেয়েদের organise করা, organisation চালান প্রভৃতি কাজের দিকে তার প্রবৃত্তি নেই, ইচ্ছাও নেই বলে”। তিন দিন ধরে ধলঘাট গ্রামে সাবিত্রী দেবীর বাডিতে অবস্থানকালে আগ্নেয়াস্ত্র triggering এবং targeting এর উপর প্রীতিলতা প্রশিক্ষন গ্রহণ করেন।
এদিকে মে মাসেই ইংরেজ প্রশাসন মাষ্টারদা এবং নির্মল সেনকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরিয়ে দিতে পারলে ১০,০০০ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেন। এত কিছুর পরেও ভীত নয় বিপ্লবীরা তদের পরিকল্পনা চলতে থাকে।
এর পরই ঘটল ছন্দপতন। ১৯৩২ সালের ১৩ জুন ক্যাম্পের অফিসার-ইন-চার্জ ক্যাপ্টেন ক্যামেরন জানতে পারে ধলঘাটের সাবিত্রি দেবীর বাড়ীতে অবস্থান করছে বিপ্লবীরা। খবরটা জানার পর ঐ বাড়িতে অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পুরস্কার এবং পদোন্নতির আশা নিয়ে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন দুজন সাব-ইন্সপেক্টর, সাতজন সিপাহী, একজন হাবিলদার এবং দুজন কনষ্টেবল নিয়ে রাত প্রায় ৯টার দিকে ধলঘাটের ঐ বাড়িতে উপস্থিত হন।
সেদিন রাতে ভোলার জন্য বিপ্লবীরা প্রীতিকে বলে ছিল সাগু জ্বাল দিতে। সাগু জ্বাল দিয়ে ঠান্ডা করে লেবু আর চিনি দিয়ে ভোলাকে খাওয়ালেন প্রীতি। হঠাৎ মাষ্টার দা নীচ থেকে বিদ্যুতবেগে ছুটে এসে বললেন. “পুলিশ এসেছে, পুলিশ এসেছে।”
ক্যাপ্টেন ক্যামেরন এবং সাব-ইন্সপেক্টর মনোরঞ্জন বোস ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ঘরের একতলায় থাকা সাবিত্রী দেবী ও তাঁর ছেলে মেয়েকে দেখতে পান।
“ঘরে আর কে আছে?” এ প্রশ্ন করে কোন উত্তর না পাওয়া অভিযান পরিচালনাকারীরা এসময় ঘরের উপরের তলায় পায়ের আওয়াজের শব্দ শুনতে পান। ক্যাপ্টেন ক্যামেরন হাতে রিভলবার নিয়ে ঘরের বাইরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিতেই নির্মল সেনের করা দুইটা গুলিতে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন মৃত্যুবরন করেন। গুলির শব্দ পাওয়ার পরেই ঘরের চারিদিকে থাকা সৈন্যরা চারিদিক থেকে প্রচন্ড গুলিবর্ষণ শুরু করে। একটা গুলি এসে নির্মল সেনের বুকে লাগে এবং প্রচুর রক্তক্ষরনে তাঁর মৃত্যু হয়। টাকা পয়সা এবং কাগজপত্র গুছিয়ে প্রীতিলতা এবং অপুর্ব সেনকে সঙ্গে নিয়ে মাষ্টারদা অন্ধকারে ঘরের বাইরে আসেন। এই সময়ে আশেপাশে থাকা সিপাহীদের চালানো গুলিতে সবার আগে থাকা অপুর্ব সেন মারা যান। মাষ্টারদা আর প্রীতিলতা সেই রাতে কচুরিপানা ভরা পুকুরে সাঁতার কেটে আর কর্দমাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে পটিয়ার কাশীয়াইশ গ্রামে দলের কর্মী সারোয়াতলী স্কুলের দশম শ্রেনীর ছাত্র মনিলাল দত্তের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছান।
পরবর্তীতে মাষ্টারদা প্রীতিলতাকে আত্মগোপনের নির্দেশ দেন। ৫ জুলাই মনিলাল দত্ত এবং বীরেশ্বর রায়ের সাথে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে প্রীতিলতা আত্মগোপন করে। ছাত্রী পড়ানোর কথা বলে তিনি বাড়ি ত্যাগ করেছিলেন। পিতা জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার অনেক খোঁজ খবর করেও কোন সন্ধান পাননি। চট্টগ্রাম শহরের গোপন আস্তানায় কিছু দিন কাটিয়ে প্রীতিলতা পড়ৈকোড়া গ্রামের রমণী চক্রবর্তীর বাড়িতে আশ্রয় নেয়।
১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অন্যতম পরিকল্পনা ছিল পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ। কিন্তু গুড ফ্রাইডের কারনে সেদিনের ঐ পরিকল্পনা সফল করা যায়নি। মাষ্টার দা একথা ভূলেনি, তাই তিনি ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমনের জন্য আবার তৎপর হন।
চট্টগ্রমে ইউরোপিয়ানদের চট্টগ্রামে দুইটি ক্লাব ছিল। একটি পল্টন ময়দানে ও অপর ক্লাবটি হল পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাব।ক্লাবের সামনের সাইনবোর্ডে লেখা ছিল “ডগ এন্ড ইন্ডিয়ান প্রহিবিটেড”। সন্ধ্যা হতেই ইংরেজরা এই ক্লাবে এসে মদ খেয়ে নাচ, গান এবং আনন্দ উল্লাস করতো। আত্মগোপনকারী বিপ্লবীরা ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের জন্য নুতনভাবে পরিকল্পনা শুরু করে।
হঠাৎ খবর এল ১৯৩২-এর ১০ আগস্ট একটা বড় অনুষ্ঠান ক্লাবে হবে। মাস্টারদা ঐ দিন শৈলশ্বর চক্রবর্তীকে নেতা করে ক্লাব আক্রমনের র্নিদেশ দেন। তখন বিপ্লবীরা আত্মগোপন করেছিল পড়ৈকোড়া গ্রামের রমণী চক্রবর্তীর বাড়ীতে। সেখান থেকে মাষ্টারদা ও প্রীতিলতাকে রেখে তারকেশ্বর দস্তিদার, কালীকিঙ্কর দে ও শৈলেশ্বর চক্রবর্তী পাহাড়তলী ক্লাবের নিকটে কাট্টলী গ্রামে ঐ ক্লাবেরই একজন বেয়ারা যোগেশ মজুমদারের বাড়িতে চলে আসে। ঐদিন
তারকেশ্বর বোমা, রিভলবার ও তরবারিতে সজ্জিতকরে বিপ্লবীদের যাত্রা করিয়ে দেন। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সাতজনের একটা দল সেদিন ক্লাব আক্রমণ করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর প্রতিজ্ঞা ছিল ক্লাব আক্রমণের কাজ শেষ হবার পর নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার যদি সুযোগ থাকে তবুও তিনি আত্মবিসর্জন দেবেন। তিনি পটাশিয়াম সায়নাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। গভীর রাতে কাট্টলীর সমুদ্রসৈকতে তাঁর মৃতদেহ সমাহিত করা হয়।
কযেকদিন পর খবর আসল ২৪ সেপ্টেম্বর পাহাড়তলী ক্লাবে জমজমাট জলসা বসবে। প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত, প্রেমলতাকে নিয়ে পাঁচজন বিপ্লবী এঅভিযান পরিচালনা করবেন। কিন্তু ১৭ সেপ্টেম্বর পুরুষবেশী কল্পনা দত্ত ধরা পরে গেলে আক্রমণে নেতৃত্বের ভার পড়ে একমাত্র নারী বিপ্লবী প্রীতিলতার উপর। এ আক্রমণে প্রীতিলতার পরনে ছিল মালকোঁচা দেওয়া ধুতি আর পাঞ্জাবী, চুল ঢাকা দেবার জন্য মাথায় সাদা পাগড়ি, পায়ে রবার সোলের জুতা। ইউরোপীয় ক্লাবের পাশেই ছিল পাঞ্জাবীদের কোয়ার্টার। এর পাশ দিয়ে যেতে হবে বলেই প্রীতিলতাকে পাঞ্জাবী ছেলেদের মত পোষাক পড়ানো হয়েছিল। আক্রমণে অংশ নেয়া কালীকিংকর দে, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, শান্তি চক্রবর্তী পোষাক ছিল ধুতি আর শার্ট। লুঙ্গি আর শার্ট পরনে ছিল মহেন্দ্র চৌধুরী, সুশীল দে আর পান্না সেন এর। বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা যোগেশ মজুমদার ক্লাবের ভিতর থেকে রাত আনুমানিক সারে নয়টার দিকে এর দিকে আক্রমণের নিশানা দেখানোর পরেই ক্লাব আক্রমণ শুরু হয়। সেদিন ছিল শনিবার, প্রায় চল্লিশজন মানুষ তখন ক্লাবঘরে অবস্থান করছিল। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা ক্লাব আক্রমণ শুরু করে। পূর্বদিকের গেট দিয়ে রিভলবার এবং বোমা নিয়ে আক্রমণের দায়িত্বে ছিলেন প্রীতিলতা, শান্তি চক্রবর্তী আর কালীকিংকর দে। রিভলবার নিয়ে সুশীল দে আর মহেন্দ্র চৌধুরী ক্লাবের দক্ষিণের দরজা দিয়ে এবং ৯ ঘড়া পিস্তল নিয়ে বীরেশ্বর রায়, রাইফেল আর হাতবোমা নিয়ে পান্না সেন আর প্রফুল্ল দাস ক্লাবের উত্তরের জানালা দিয়ে আক্রমণ শুরু করেছিলেন। প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেবার পরেই ঘন ঘন গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব কেঁপে কেঁপে উঠছিল। সাহেবদের গানের জলসাকে শ্মশানের রূপ দিয়ে বিপ্লবীরা ফিরে আসলে ও সেদিন ফিরে আসিনি একজন। তিনি ছিলে বাঙলার অগ্নিযুগের প্রথম নারী শহীদ প্রীতিলদা ওয়াদ্দেদার। একজন মিলিটারী অফিসারের রিভলবারের গুলিতে প্রীতি
“আমি ঐকান্তিক ভাবে আশা করি যে, আমার দেশের ভগিনীরা আর নিজেদেরকে র্দুবল মনে করিবেন না। সশস্ত্র ভারতীয় নারী সহস্র বিপদ ও বাধাকে র্চূণ করিয়া এই বিদ্রোহ ও সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনে যোগদান করিবেন এবং তাহার জন্য নিজেকে তৈয়ার করিবেন- এই আশা লইয়াই আমি আজ এই আত্মদানে অগ্রসর হইলাম।”
***সমাপ্ত***
আমি তোমার এই আত্নদানে মুগ্ধ হলাম
উত্তরমুছুন