অনুবাদ: আনিকা শাহ
বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে সোয়ামি হঠাৎ বুঝতে পারলো যে দিনটি সোমবার। যদিও এক মুহূর্ত আগেও মনে হচ্ছিল যে শুক্রবারের শেষ প্রহরটি চলছিল কিন্তু ইতোমধ্যেই সোমবার এসে গিয়েছে। সে আশা করল যেন একটা ভূমিকম্প এসে স্কুলের দালানটাকে ধূলিস্মাৎ করে দেয়, কিন্তু অ্যালবার্ট মিশনারী স্কুলের সেই দৃঢ় দালানটি এই একই প্রার্থনা উপেক্ষা করে প্রায় একশ বছরেরও ওপর হলো দাঁড়িয়ে আছে।
নয়টা বাজলে সোয়ামীনাথন আর্তনাদ করে উঠল, “আমার মাথা ব্যাথা।” তার মা বললেন, দতুই একটা জাটকায় ( ঘোড়া-টানা দুই চাকাওয়ালা গাড়ি) করে চলে যাস না কেন?”
“রাস্তার ঐ মাথায় যেয়ে আমি মারা যাই আর কি? তুমি জান জাটকায় ঝাঁকি খেতে কেমন লাগে?”
“তোর কি আজকে কোনো জরুরি পড়া আছে?”
“জরুরি না ছাই! ভূগোলের শিক্ষক তো এক বছরের ওপর হয়ে গেল একই পড়া পড়াচ্ছেন। আর গণিতের ক্লাস আছে, তার মানে পুরো একটা পিরিয়ড ধরে টিচারের মার খেতে হবে।…জরুরি পড়া!”
এবং মা তখন উদার হয়ে সোয়ামিকে স্কুলে না যাবার পরামর্শ দিলেন।
সাড়ে নয়টায়, যখন সোয়ামির স্কুলের মাঠে চিৎকার করার কথা ছিল তখন সে তার মার ঘরের খাটের ওপর শুয়ে থাকল।
ওর বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “স্কুল নাই আজকে?”
“মাথা ব্যাথা।” সোয়ামি উত্তর দিল।
“বাজে কথা! কাপড় পড়ে স্কুলে যা।”
“মাথা ব্যাথা।”
“তো রবিবারে এখানে সেখানে একটু কম ঘোরাঘুরি করলেই সোমবার আর মাথাব্যাথা থাকে না।”
সোয়ামি জানত যে তার বাবা কতটা একগুঁয়ে তাই সে তার কৌশল পরিবর্তন করল। “তাই বলে আমি এত দেরিতে স্কুলে যেতে পারি না।”
“স্কুলে তো তোকে যেতেই হবে কারণ এটা তোর নিজেরই দোষ। না যাওয়ার কথা ভাবার আগে তুই আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারতি।”
“কিন্তু আমি এত দেরিতে গেলে টিচার কী ভাববে?”
“তাকে বলিস যে তোর মাথা ব্যথা ছিল তাই দেরি হয়েছে।”
“একথা বললে সে আমাকে ধরে মারবে।”
“তাই নাকি? দেখি, তার নাম কী?”
“স্যামুয়েল।”
“সে ছেলেদের মারে?”
“সে খুবই হিংস্র , বিশেষ করে দেরিতে আসা ছেলেদের প্রতি। কয়েকদিন আগে একটা ছেলে দেরিতে আসায় ওকে পুরো একটা পিরিয়ড নীলডাউন হয়ে থাকতে হয়েছিল, তারপর তাকে ছয়টা বেতের বাড়ি এবং কানমলা খেতে হয়েছিল। আমি স্যামুয়েলের ক্লাসে দেরিতে যেতে চাই না।”
…….
ছয় বছর বয়সে আর. কে. নারায়ণ, সাল ১৯১২।
…….
“সে যদি এতই হিংস্র হয়, তাহলে তোরা এ ব্যাপারে হেডমাস্টারকে কিছু বলিস না কেন?”
“সবাই বলে যে এমনকি হেডমাস্টারও স্যামুয়েলকে ভয় পায়। সে এতই হিংস্র।”
তারপর সোয়ামি স্যমুয়েলের হিংস্রতার একটি ভয়ংকর বর্ণনা দিল: কীভাবে সে একবার কাউকে বেতানো শুরু করলে তার হাতে রক্ত না দেখা পর্যন্ত থামত না; তারপর ছেলেটিকে সেই রক্ত সিঁদুরের ফোঁটার মত কপালে লাগাতে বাধ্য করত।
সোয়ামি আশা করল যে তার বাবা হয়ত বুঝবে যে সে দেরিতে স্কুলে যেতে পারবে না। কিন্তু তার বাবার ব্যবহারে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন আসল। তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। “এরা আমাদের ছেলেদের মেরে কী বোঝাতে চায়? এদের চাকরি থেকে বের করে দেওয়া উচিত। আমি দেখব…।”
ফলাফল এমন হল যে, তিনি সোয়ামিকে স্কুলে পাঠানোটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেন। তিনি সোয়ামির সাথে হেডমাস্টারের জন্য একটি চিঠি দিবেন বলেও ঠিক করলেন। সোয়ামির শত আপত্তি সত্বেও কোনো লাভ হলো না–তাকে স্কুলে যেতেই হল।
সোয়ামি স্কুলের জন্য তৈরি হতে হতে তার বাবা হেডমাস্টারের জন্য একটি চিঠি লিখে খামে ভরে সীল করে দিল।
“তুমি এখানে কী লিখেছো বাবা?” সোয়ামি শঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করল।
“তোর জন্য কিছু না। এটা হেডমাস্টারকে দিয়ে তারপর তুই ক্লাসে যাবি।”
“তুমি কি আমাদের শিক্ষক স্যামুয়েল সম্পর্কে কিছু লিখেছো?”
“তার সম্পর্কে অনেক কিছুই লিখেছি। তোর হেডমাস্টার যখন এটা পড়বেন তখন তিনি সম্ভবত স্যামুয়েলকে বরখাস্ত করবেন এবং পুলিশে দিয়ে দিবেন।”
“সে কী করেছে বাবা?”
“সে যা যা করেছে তার সমস্ত কিছুর বর্ণনা এখানে আছে। তুই তোর হেডমাস্টারকে এটা দিয়ে ক্লাসে যাবি। তার মতামত নিয়েই বিকেলে তুই বাড়ি ফিরবি।”
স্কুলে যেতে যেতে সোয়ামির মনে হল যে সে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মিথ্যাবাদী। তার নীতিবোধ তাকে পীড়িত করতে লাগল। সে জানত না যে স্যামুয়েল সম্পর্কে তার দেয়া সমস্ত বর্ণনা আদৌ সঠিক ছিল কিনা। তার বলা কথার কতটুকু বাস্তব এবং কতটুকু কল্পিত ছিল সে সম্বন্ধে সে নিশ্চিত হতে পারছিল না।
সে রাস্তার ধারে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়াল, স্যামুয়েল সম্পর্কে তার ধারণাগুলো স্থির করার জন্য। সে মানুষ হিসেবে ততটা খারাপও নয়। ব্যক্তি হিসেবে সে অন্যদের চেয়ে অমায়িক ছিল। মাঝে মাঝে সে সোয়ামির আলস্যকে কেন্দ্র করে দু’একবার ঠাট্টা করত এবং সোয়ামি সেটাকে তার প্রতি স্যামুয়েলের ব্যক্তিগত বিবেচনা হিসেবেই মনে করত। কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নেই যে স্যামুয়েল মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করত…তার বেত মানুষের হাতের চামড়া উঠিয়ে ফেলত।
সোয়ামি এসব ঘটনার উদাহরণ মনে করার চেষ্টা করল কিন্তু তার জানা এমন কোনো দৃষ্টান্ত ছিল না।
অনেক বছর আগে প্রথম শ্রেণীর একজন ছেলের আঙুলের গাটের চামড়া ছিলে ফেলার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনা কেউ দেখেনি, কিন্তু বছরের পর বছর গল্পটি ছাত্রদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল।
স্যমুয়েলের চরিত্র আসলে ভাল নাকি খারাপ, সে কি আসলেই চিঠিতে লেখা অভিযোগগুলোর যোগ্য কিনা–এই বিভ্রান্তিতে সোয়ামির মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগল। তার মনে হতে লাগল দৌড়ে বাসায় গিয়ে তার বাবাকে চিঠিটি ফিরিয়ে নেবার অনুরোধ করে। কিন্তু তার বাবা ছিল বড়ই একগুঁয়ে।
স্কুলের হলুদ দালানটার কাছে এসে তার মনে হলো সে নিজের সাথেই মিথ্যাচার করেছে এবং তার শিক্ষকের ক্ষতি করেছে। হেডমাস্টার সম্ভবত স্যামুয়েলকে বরখাস্ত করবেন এবং তারপর পুলিশ তাকে জেলে আটকে রাখবে। তার এই অসম্মান, অপমান ও দুর্দশার জন্য কে দায়ী থাকবে? সোয়ামি কেঁপে উঠল। যত বেশি সে স্যামুয়েলের কথা চিন্তা করতে লাগল ততই সে দুঃখ পেতে লাগল। তার কালো হয়ে যাওয়া চেহারা, ছোট হয়ে আসা লাল , ভাঁজ-পড়া চোখ, সূক্ষ্ম গোফের রেখা, না কামানো গাল ও চিবুক, হলুদ কোটÑ এসব চিন্তা সোয়ামিকে পীড়িত করে তুলল। যখনই সে তার পকেটের ভেতর খামটার অস্তিত্ব অনুভব করছিল, তার মনে হচ্ছিল যেন সে একজন জল্লাদ। এক মুহূর্তের জন্য সে নিজের বাবার ওপর রেগে উঠল এবং ভাবল, এমন যুক্তিবহির্ভূত এবং জেদী একজন মানুষের চিঠি সে কেন ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে না।
সে যখন স্কুলের গেটে ঢুকল, তার মাথায় একটা বুদ্ধি আসল; অনেকটা সমাধানের মত। সে এখনই হেডমাস্টারকে চিঠিটা দিবে না। বাবার অবাধ্য হয়ে এবং নিজের স্বাধীনতার চর্চা করে সে দিনের শেষে চিঠিটা দিবে। এতে অন্যায় কিছুই নেই এবং বাবাও কোনোভাবেই এটা জানতে পারবে না। তাছাড়া সে যদি দিনের শেষেই চিঠিটা দেয় তাহলে স্যামুয়েল এমন কিছু করতে পারে যাতে চিঠিটার সত্যতা প্রমাণিত করার সুযোগ আসে।
সোয়ামি ক্লাসের প্রবেশপথের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল। স্যামুয়েল তখন গণিত পড়াচ্ছিলেন। তিনি কিছুক্ষণ সোয়ামির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। সোয়ামির আশা ছিল স্যামুয়েল তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন এবং তার চামড়া ছিলে ফেলবেন। কিন্তু তিনি শুধুমাত্র জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি এইমাত্র ক্লাসে আসলে?”
“জ্বি, স্যার।”
“তুমি দেড় ঘণ্টা দেরিতে এসেছ।”
“আমি জানি।” সোয়ামি আশা করল তাকে এখনই আক্রমণ করা হবে। সে প্রায় প্রার্থনা করতে শুরু করল: তিরুপতি ভগবান, স্যামুয়েল যেন আমাকে মারে।
“এত দেরিতে এলে কেন?”
সোয়ামি উত্তর দিতে চাইল, “তুমি কী করো তা দেখার জন্য।” কিন্তু সে শুধু বলল, “আমার মাথাব্যাথা, স্যার।”
“তাহলে তুমি স্কুলে আসলেই বা কেন?”
স্যামুয়েলের কাছ থেকে একদমই অপ্রত্যাশিত একটা প্রশ্ন।
“আমার বাবা বললেন যে আমার ক্লাস বাদ দেয়া উচিত হবে না,” সোয়ামি বলল।
একথা স্যামুয়েলকে প্রভাবিত করল বলে মনে হল। “তোমার বাবার কথা একদম ঠিক। তিনি খুবই বিচক্ষণ ব্যক্তি। আমরা তার মত অভিভাবক আরও চাই।”
“আহা! বেচারা,” সোয়ামি ভাবল। “যদি তুমি জানতে আমার বাবা তোমার সাথে কী করেছে!”
সোয়ামি কখনও স্যামুয়েলের স্বভাব সম্পর্কে এত হতবুদ্ধি হয়নি।
“ঠিক আছে, তুমি তোমার সিটে যাও। এখনও কি তোমার মাথাব্যাথা আছে?”
“সামান্য আছে, স্যার।”
সোয়ামি দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে সিটে গেল। সে কখনও স্যামুয়েলের মত এমন ভাল মানুষ দেখেনি। তিনি বাড়ির কাজগুলো দেখছিলেন যা সাধারণত হিংস্রতায় পূর্ণ কিছু দৃশ্য উৎপন্ন করত (অন্তত সোয়ামির তাই ধারণা)। নোটবই মুখের ওপর ছুড়ে ফেলার কথা, ছেলেদের সাথে খারাপ ব্যবহার করার কথা, বেত মারা এবং বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখার কথা। কিন্তু আজ স্যামুয়েলকে দেখে মনে হল তার সহ্যশক্তি এবং ভদ্রতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। খারাপ খাতাগুলো সে দূরে ঠেলে দিল, ছেলেদের গায়ে বেতটা ছোঁয়ালো মাত্র এবং কাউকেই কয়েক মিনিটের বেশি দাঁড় করিয়ে রাখল না। সোয়ামির পালা এলো। সে এই সুযোগের জন্য ভগবানকে ধন্যবাদ জানালো।
“সোয়ামীনাথন, তোমার বাড়ির কাজ কোথায়?”
“আমি বাড়ির কাজ করিনি, স্যার,” সে নম্রভাবে জবাব দিল।
কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে স্যামুয়েল জিজ্ঞেস করলেন, “কেন, মাথাব্যাথা?”
“জ্বি স্যার।”
“ঠিক আছে, বসো।”
সোয়ামি বসল এবং ভাবতে লাগল স্যামুয়েলের হয়েছেটা কী। ক্লাস শেষ হয়ে গেল এবং সোয়ামি বড়ই নিরানন্দ বোধ করতে লাগল।
সেদিন শেষের ক্লাসটা আবার স্যামুয়েল নিলেন। ক্লাস ৩:৪৫ টায় শুরু হল এবং ৪:৩০ এ শেষ হবার কথা ছিল। তিনি এবার ‘ভারতীয় ইতিহাস’ পড়াতে এলেন।
এর আগের পিরিয়ডগুলোতে সোয়ামি গভীরভাবে চিন্তা করেছিল। কিন্তু স্যামুয়েলকে রাগানোর বা উত্তেজিত করার কোনো পরিকল্পনাই সে করে উঠতে পারছিল না। ঘড়িতে চারটা বাজতেই সোয়ামি মরিয়া হয়ে উঠল। আর মাত্র আধ ঘণ্টা। স্যামুয়েল একটা বই পড়ছিলেন যেখানে ভাস্কো-ডা-গামার ভারত আসার কথা বর্ণিত ছিল। ছাত্ররা প্রায় নির্জীব ভাবে শুনছিল। সোয়ামি উচ্চস্বরে বলল, “কলম্বাস কেন ভারতে আসেননি স্যার?”
“তিনি পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন।”
“আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, এটা অবিশ্বাস্য, স্যার।”
“কেন?”
“এত মহান মানুষ; তিনি কি রাস্তা জানতেন না?”
“চিৎকার করো না আমি তোমার কথা ভালোভাবেই শুনতে পাচ্ছি।”
“আমি চিৎকার করছি না, স্যার, এটা আমার স্বাভাবিক স্বর যা কিনা ঈশ্বরের দেওয়া। আমি এর কীইবা করতে পারি ?”
“তুমি চুপ করে বসো।”
সোয়ামীনাথন বসল। নিজের সাফল্যে সে খানিকটা খুশিই হল।
শিক্ষক খানিকটা ধাঁধা এবং সন্দেহ নিয়ে তার দিকে তাকালেন এবং পুনরায় পড়ানো শুরু করলেন।
এর পর সুযোগ আসল যখন প্রথম বেঞ্চে বসা শংকর জিজ্ঞেস করল, “স্যার, ভাস্কো-ডা-গামাই কি ভারতে আসা প্রথম মানুষ ছিলেন?”
শিক্ষক উত্তর দেওয়ার আগেই পেছনের বেঞ্চ থেকে সোয়ামি চিৎকার করে উঠল, “সবাই তো তাই বলে।”
টিচার এবং সব ছেলেরা তার দিকে তাকালো। সোয়ামির আজকের অবাঞ্ছিত ব্যবহারে স্যামুয়েল রীতিমতো হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলেন। “সোয়ামীনাথন, আবার চিৎকার করছ তুমি?”
…….
নারায়ণের প্রথম উপন্যাস সোয়ামি অ্যান্ড ফ্রেন্ডস
…….
“আমি চিৎকার করছি না, স্যার। ঈশ্বরের দেওয়া কণ্ঠের আমি কীইবা করতে পারি?” স্কুলের ঘড়ি বলল যে সোয়া এক ঘণ্টা শেষ। আর পনের মিনিট। সোয়ামির মনে হল যে এই পনের মিনিটে তার সাংঘাতিক কিছু একটা করতে হবে। স্যামুয়েল কয়েকবার ভ্রুকুটি করল এবং তিরস্কার করল কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না। সোয়ামির মনে হল যে আরেকটু চেষ্টা করলেই স্যামুয়েলকে বরখাস্ত ও কারারুদ্ধ করা যেতে পারে।
শিক্ষক বইয়ের একটা অংশ শেষ করে থামলেন। তিনি বললেন যে তিনি বাকি সময়টুকু ছেলেদের প্রশ্ন করবেন।
তিনি ক্লাসের সবাইকে বই সরিয়ে রাখার নির্দেশ দিলেন এবং দ্বিতীয় সারিতে বসা কাউকে জিজ্ঞেস করলেন, “ভাস্কো-ডা-গামার ইন্ডিয়ায় আসার তারিখ কত?”
সোয়ামি হঠাৎ কর্কশ স্বরে বলল, “১৬৪৮, ডিসেম্বর ২০।”
“তোমার চেঁচানোর দরকার নেই,” শিক্ষক বললেন।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার মাথাব্যাথা কি তোমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে?”
“আমার এখন মাথাব্যাথা নেই, স্যার”, সে বজ্রধ্বনির মত উচ্চকণ্ঠে উত্তর দিল।
“বসো, মূর্খ কোথাকার।” সোয়ামিকে মূর্খ বলায় সে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল।
“আরেকবার যদি তুমি উঠে দাঁড়াও তাহলে আমি তোমাকে বেত দিয়ে মারব,” শিক্ষক বললেন। সোয়ামি এই প্রতিশ্রুতির কথা শুনে আনন্দের সাথে বসল।
শিক্ষক তখন বললেন, “আমি মুঘল পর্যায় সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করব। মুঘল রাজাদের মধ্যে কাকে তোমরা সবচেয়ে মহান, কাকে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং কাকে সবচেয়ে ধর্মপরায়ণ বলবে?”
সোয়ামি উঠে দাঁড়ালো। ওকে দেখা মাত্রই শিক্ষক জোর দিয়ে বললেন, “বসো।”
“আমি উত্তর দিতে চাই, স্যার।”
“বসো।”
“না, স্যার, আমি উত্তর দিতে চাই।”
“তুমি আবার উঠে দাঁড়ালে আমি কী করব বলেছিলাম?”
“আপনি বলেছিলেন যে আপনি আমাকে বেত দিয়ে মারবেন এবং আমার আঙুলের চামড়া উঠিয়ে ফেলবেন এবং সেটা আমার কপালে লাগাতে বাধ্য করবেন।”
“ঠিক আছে, এদিকে আসো।”
সোয়ামীনাথন আনন্দের সাথে সিট ছেড়ে উঠল এবং রীতিমতো লাফ দিয়ে সামনে গেল। শিক্ষক ড্রয়ার থেকে বেত বের করে রাগান্বিত স্বরে চিৎকার করলেন, “হাত পাতো, শয়তান কোথাকার!”
প্রতিটি হাতে তিনি তিনটা করে বাড়ি দিলেন। সোয়ামি সংকুচিত না হয়েই সেগুলো গ্রহণ করল।
অর্ধডজন বাড়ি দেবার পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “এগুলো কি যথেষ্ট নাকি তুমি আরো চাও?” সোয়ামি আবার হাত বাড়িয়ে দিয়ে আরো দুটো বাড়ি খেল; এমন সময় ঘণ্টা বাজল।
১৯৩৫ সালে আর. কে. নারায়ণকে তাঁর উপন্যাসের জন্য প্রকাশক পাওয়ার কথা জানাচ্ছেন গ্রাহাম গ্রিন।
সোয়ামি হালকা মন নিয়ে সেখান থেকে লাফিয়ে নামল, যদিও তার হাতে সে হুল ফোটার মত ব্যথা অনুভব করছিল। সে নিজের বইগুলো নিল, পকেট থেকে চিঠিটা বের করল এবং হেডমাস্টারের রুমের দিকে দৌড় দিল। সে পিওনকে জিজ্ঞেস করল, “হেডমাস্টার কোথায়?”
“তাকে তোমার কী দরকার?”
“আমার বাবা তার জন্য একটা চিঠি দিয়েছেন।”
“তিনি তো আজ দুপুরবেলাই ছুটি নিয়েছেন, আর দুই সপ্তাহের মধ্যে আসবেন না। তুমি অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টারকে চিঠিটা দিতে পার।”
“তিনি কে?”
“তোমাদের শিক্ষক স্যামুয়েল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তিনি চলে আসবেন।”
“সোয়ামীনাথন সেখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে গেল। চিঠিসহ সে যখন বাড়ি পৌঁছলো, তার বাবা মন্তব্য করলেন, “আমি জানতাম তুই চিঠিটা দিতে পারবি না, ভীরু কোথাকার।”
“আমি দিব্যি দিচ্ছি, আমাদের হেডমাস্টার ছুটিতে…”, সোয়ামি শুরু করল।
বাবা বললেন, “তোর ভীরুতাকে ঢাকার জন্য মিথ্যা কথা বলার দরকার নেই।”
সোয়ামি খামটা দেখিয়ে বলল, “হেডমাস্টার ফিরে আসার সাথে সাথেই আমি এটা তাকে দিব।”
বাব তার হাত থেকে চিঠিটা কেড়ে নিয়ে ছিড়ে ফেললেন এবং টেবিলের নিচে রাখা ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিলেন। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, “এরপর স্যামুয়েল তোর টুঁটি চেপে ধরলেও আমার কাছে আসিস না। তুই তোর স্যামুয়েলেরই যোগ্য।”
সূত্র- arts.bdnews24.com